অনুভূতি
পর্ব -১৪
মিশু মনি
অনুভূতি সকল পর্ব
অনুভূতি ! পর্ব_১
অনুভূতি ! পর্ব_২
৪১.
রাতারগুলে নৌকায় ওঠার সময় লাইফ জ্যাকেট পড়তে হলো মিশুকে। মেঘালয় ওকে জ্যাকেট পড়িয়ে দিয়ে হাত ধরে নৌকায় তুললো। নৌকায় পা রাখতেই নৌকা দুলে উঠলে মেঘালয় শক্ত করে ধরে ফেললো ওকে। ঘাটে থাকা মাঝি আর সমস্ত ট্রাভেলার্স হা করে চেয়ে আছে ওদের দিকে। মেঘালয় বারবার বলছে, “একটু সাবধানে পা ফেলো মিশু, এইদিকে পা দিওনা,এইখানে পা রাখো, পড়ে যাবা একটু সাবধানে।” এই টাইপের কথাবার্তা আর ওর মিশুকে আগলে রাখার ধরণ দেখে লোকজন বুঝে গেছে ছেলেটা মেয়েটাকে কতটা ভালোবাসে।
একজন মহিলা তার স্বামীকে বললো, “দেখেছো কিরকম কেয়ার করে? সব মেয়েই এরকম কেয়ার চায়। সারাজীবন সাধনা করে হয়ত এরকম জীবনসঙ্গী পাওয়া যায়।”
কথাটা মিশুর কানে লাগলো এসে। কেবলই নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হচ্ছিলো ওর।সবাই যেভাবে চেয়ে আছে তাতে খুব লজ্জাও লাগলো। নৌকায় বসে সামনের দিকে তাকিয়ে রইলো ও। ওর পাশে বসে মেঘালয় ওর হাত ধরে রেখেছে। বাকি তিনজন পিছনের দিকে বসেছে। নৌকা ছেড়ে দিলো।
নৌকায় দুজন মাঝি। একজন বয়স্ক লোক আরেকজন ওনার ছেলে। ছেলেটি নিতান্তই ছোট। বয়স এগারো/বারো হবে হয়ত। সে দিব্যি গায়ের জোরে নৌকার দাড় বাইছে। ধীরেধীরে বনের ভেতর প্রবেশ করলো ওরা। মিশুর চোখ বিস্ময়ে বড়বড় হয়ে গেলো। পানির রঙ একদম গাঢ় সবুজ, আর সামনে যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। জংগলের ভেতর দিয়ে ক্রমশই নৌকা ভেতরে ঢুকছিলো। মিশু আনন্দে লাফিয়ে ওঠার মত অবস্থা। নতুন নতুন কিছু গাছ, গাছের ও অন্যরকম একটা গন্ধ আছে। প্রাণভরে ও গাছের গন্ধ নিতে লাগলো। পানিতে ছপছপ শব্দ তুলে নৌকা বনের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ফরেস্টের গভীরে ঢুকে রীতিমত গা ছমছম করতে লাগলো। নিচেও সবুজ পানি, মাথার উপরেও ঘন গাছের ডালপালা বিস্তৃত হয়ে আছে, দুপাশেই ঘন জংগল। বেশ থ্রিলিং লাগছে মিশুর কাছে। ও শিহরিত হয়ে উঠছে বারবার। আর মেঘালয় চেয়ে আছে ওর মুগ্ধ চোখের দিকে। মিশুকে সবচেয়ে বেশি সুন্দর লাগে মুগ্ধ হলে, আর সবচেয়ে বেশি স্নিগ্ধ লাগে স্নানের পর।
বনের গভীর থেকে গভীরে নৌকা প্রবেশ করছে। দুপাশের ডালপালা এসে গায়ে লাগছে। একদম ঘন জংগলে ঢোকার পর মেঘালয় বললো, “মামা একটু দাঁড়ান তো।”
মাঝি দাড় বাওয়া বন্ধ করতেই মেঘালয় আস্তে করে উঠে দাঁড়িয়ে হাত ধরে মিশুকে তুললো। মিশুকে একটানে বুকে নিয়ে বললো, “পূর্ব ক্যাপচার।”
পূর্ব টুক করে ক্যামেরায় ক্লিক করে নিলো। ঘন সবুজের মাঝে দুজন সুখী মানুষ একে অপরের দিকে চেয়ে আছে! মিশু মেঘালয়ের বুকে ভর দিয়ে মাথাটা উপর দিকে তুলে মুগ্ধ চোখে চেয়ে আছে মেঘালয়ের দিকে। মিশুর গলায় আবার চাটনি ও ঝুলছে। পূর্ব বললো, “চাটনিকন্যা চাটনি গুলা রেখে একটা ছবি তুলুন প্লিজ। হাস্যকর লাগছে।”
মিশু চাটনি গুলো গলা থেকে নামিয়ে নৌকায় ফেললো। মেঘালয় মিশুর কোমরে হাত রেখে কাছে টেনে নিলো। এক হাত মেঘালয়ের বুকের উপর, আরেকহাত মেঘালয়ের গলায় জড়িয়ে ধরে রেখে মিশু তাকালো গাছের দিকে আর মেঘালয় তাকিয়ে রইলো মিশুর দিকে। পূর্ব ছবি ক্লিক করে নিলো। তারপর খুশি খুশি গলায় বললো, “এই বছরের সেরা ছবি দোস্ত।”
মেঘালয় মিশুর হাত ধরে বসালো ওকে। নৌকা আবারো চলতে শুরু করলো। মেঘালয় মাঝিকে বললো, “মামা কি রাগ করছেন?”
মাঝি হাসলো, “না মামা রাগ করিনাই।”
মেঘালয় হেসে জবাব দিলো, “আমার বউ হয় মামা। গত পরশু আমাদের বিয়ে হইছে।”
– “সুন্দর মানাইছে আপনাদের। আল্লাহ নিজে আপনাদের একজনরে আরেকজনের জন্য বানাইছে।”
মিশু লাজুক ভঙ্গিতে হাসলো। মেঘালয় বললো, “মামা আরো বিরক্ত করবো। কিছু ফটোশুট করবো। রাগ করবা মামা?”
– “না, আমার রাগ নাই।”
নৌকার ছোটমাঝি অর্থাৎ বাচ্চা ছেলেটি হঠাৎ গান গাইতে শুরু করলো। ওর গানের গলা শুনে সকলকে একবার মুগ্ধ হতেই হলো। মেঘালয় ও ওর বন্ধুরাও যোগ দিলো সাথে। এরকম একটা ছোট বাচ্চা এত সুন্দর গান গাইতে পারে ওরা ভাবতেও পারেনি। আরাফ পুরো গান সহ বনের দৃশ্য ভিডিও করে নিলো।
নৌকা বাক নেয়ার সময় মেঘালয় বিভিন্ন স্টাইলে মিশুর ছবি তুলে নিলো। মিশুর ও ছবি তুলতে খুবই ভালো লাগে। ও নানান পোজ দিয়ে ছবি তুলছে।মেঘালয় বললো, “আমি কখনোই এত ছবি তুলিনা। আজকে তুলছি কারণ এগুলা স্মৃতি হয়ে থাকবে। কোনো একদিন আমাদের বাড়িতে ভক্তরা আসবে ঘুরতে, বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে এই ছবিগুলো স্মৃতি হয়ে ঝুলবে। ক্যাপশনে থাকবে, “বিয়ের পরদিন প্রথম মধুচন্দ্রিমা”
পূর্ব বললো, “দোস্ত মধুচন্দ্রিমার মত কিছুই তো করলি না।”
– “পাবলিকের সামনে করবো নাকি? আজব তো।”
সবাই হেসে উঠলো। মিশু লজ্জায় লাল থেকে নীল,নীল থেকে বেগুনী হতে লাগলো। ওর লাজুক চেহারাটা ফটাফট ক্যামেরায় ধারণ করছে পূর্ব। ওদের অজান্তেই দুজনের অনেক ছবি তুলে নিলো ও। মিশুকে সবাই ভীতু ভেবেছিলো, ও সেরকম একটুও নয়। ছবি তোলার সময় বারকয়েক নৌকা দুলে উঠেছিলো।মিশু পড়েও যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলো কয়েকবার। অন্য মেয়ে হলে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বন মাথায় তুলতো। মিশু দিব্যি উৎফুল্ল হয়ে বসে আছে। ওর বরং আফসোস হচ্ছে কেন পড়ে গেলো না সেটা ভেবে। পড়লে এই সবুজ জলের গন্ধটাও গায়ে মেখে নিতে পারতো। এসব ভাবছে আর চাটনি খেয়ে যাচ্ছে অনবরত।
রাতারগুলের ভেতরে যে টাওয়ারটা আছে সেখানে এসে নৌকা দাড় করালো। মেঘালয় হাত ধরে মিশুকে উপরে তুললো। অনেক উঁচু টাওয়ার। সবাইকে নিচে দাড় করিয়ে পূর্বকে নিয়ে একদম চূড়ায় উঠে গেলো ও। বেশি মানুষ উঠলে টাওয়ার দুলে উঠে,কেঁপে ওঠে। তাই বাকিরা নিচেই রইলো। মিশু সবকিছু উপভোগ করছে একদম ভেতর থেকে। মেঘালয়কে জড়িয়ে ধরে থ্যাঙ্ক ইউ বলতে ইচ্ছে করছে ওর। উপরে উঠেও দুজনের অসংখ্য ছবি তুললো পূর্ব। একদম চূড়ায় মিশু মুগ্ধ হয়ে বনের দিকে চেয়ে আছে আর মেঘালয় পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে আছে ওকে। নেমে আসার পর বাকিরা উপরে উঠলো আর মেঘালয় ফাঁকা নৌকায় শুয়ে মিশুকে বুকে নিয়ে ছবি তুললো। অনেক ট্রাভেলার্স ইমপ্রেসড ওদের এনার্জি আর প্রেম দেখে।
বেশ কিছুক্ষণ প্রাণভরে শ্বাস নিলো ওরা। মিশু বিস্ময়ে কথাই বলতে পারছে না। অনেকে মিশুর গলায় ঝোলানো চাটনি দেখে অবাক হয়ে থাকতো। মিশু তাদেরকে বলতো, “চাটনি খাবেন? তিন টাকা পিছ।” যাকে বলা হতো সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যেতো একদম। মিশু একটা চাটনি ছিড়ে তাদের হাতে দিয়ে দিতো। সে টাকা বের করতে গেলে ও বলতো, “টাকা লাগবে না। এমনি দিছি। এমনির আরেক নাম তিন টাকা।”
সবাই আরো বেশি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যেতো। “এমনির আরেক নাম তিন টাকা” এরকম বাক্য এ জনমে কেউ শোনেনি বোধহয়। মেঘালয়ের বন্ধুরা মিশুর কথাবার্তা আর কাণ্ড দেখে মজা পাচ্ছিলো। পুরো বনটা নৌকায় ঘোরার পর ধীরেধীরে আবারো ঘাটের দিকে ফেরা হলো। মিশুর মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ওর মুখটা ছোট্ট একটু হয়ে গেছে।
মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, “কি হইছে মিশুমনি?”
– “আমার ওই বনের ভেতর থেকে যেতে ইচ্ছে করছিলো। একদম ই ফিরতে ইচ্ছে করছে না।”
– “আহারে বাচ্চাটা। মন খারাপ করে না সোনামণি। আমরা যতক্ষণ ভেতরে ছিলাম, এতক্ষণ কেউ ওখানে থাকেনা রে। মামাকে কতক্ষণ বসিয়ে রাখলাম দেখোনি? এর বেশি সময় ওখানে থাকে কেউ?”
মিশু মুখটা কালো করে বসে রইলো। সবই বুঝতে পারছে তবুও ওর মন খারাপ লাগছে। মেঘালয়ের ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখতে। কিন্তু পাবলিক প্লেসে সেটা সম্ভব না। মিশুর মন খারাপ করা চেহারা দেখে ওর ও খারাপ লাগছে। ঘাটে ফেরার আগেই মেঘালয় মাঝিকে কিছু বখশিশ দিয়ে দিলো। যেটা ঠিক করা হয়েছিলো সেটা নিয়েই অনেকে দরদাম করে, সেখানে এক্সট্রা বখশিশ পেয়ে মাঝি খুশি হয়ে গেলেন। ঘাটে ফিরেই মেঘালয় দেড়ি না করে মিশুকে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠলো।
সায়ান এক বোতল পানি এনে দিলো। মিশু পানি খেয়ে সিটে চুপচাপ বসে রইলো। মেঘালয় দুহাতে ওর মুখটা ধরে বললো, “এই পাগলী, মন খারাপ করে থাকবা? তুমি জানো না তুমি এরকম গাল ফুলিয়ে বসে থাকলে আমার ও মন খারাপ হয়ে যায়?”
মিশু মেঘালয়ের বুকে মাথা রেখে বললো, “সবকিছু এত সুন্দর কেন? বেশি সুন্দর দেখলে আমার মন খারাপ হয়ে যায়। আমি কেমন যেন হয়ে যাই।”
– “কাল তোমাকে আরো সুন্দর একটা জায়গায় নিয়ে যাবো পাগলী। কাল একদম সকাল সকাল বের হবো, সারাটা দিন তুমি সেখানে প্রকৃতির কোলে বসে থাকবা।”
মিশু আর কিছু বললো না। পূর্বরা গাড়ির কাছে আসছে দেখে ও সোজা হয়ে বসলো।
গাড়ি ছেড়ে দেয়ার পর আশেপাশের সৌন্দর্য দেখে ওর মন ভালো হয়ে যাচ্ছিলো। বিকেল গড়িয়ে এসেছে। খাবার খেয়ে পান্থুয়ামাই চলে গেলো ওরা। কিন্তু সময়ের অভাবে বেশিক্ষণ থাকা হলোনা। মিশুর মনটা একটু ভালো হতে শুরু করেছিলো, আবারো খারাপ হয়ে গেলো। ও কোনো কথা না বলে একদম গম্ভীর হয়ে বসে রইলো।
৪২.
হোটেলে ফিরে মিশুকে ফ্রেশ হতে বলে পূর্ব’র সাথে কথা বলার জন্য ওদের রুমে গেলো মেঘালয়। রুম থেকে বেড়িয়ে নিজের রুমে ঢুকতে যাবে এমন সময় পিছন থেকে একজন ডাকলো, “আরে মেঘালয় না?”
মেঘালয় পিছন তাকাতেই খুশি হয়ে উঠলো – অরণ্য!
অরণ্য মেঘালয়ের ছোটবেলার বন্ধু ছিলো। কলেজে ওঠার পর সবাই যে যার মত আলাদা হয়ে গেছে। কিন্তু খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিলো ওদের। মেঘালয় গিয়ে অরণ্যকে জড়িয়ে ধরে বললো, “কেমন আছিস বন্ধু?”
– “ভালো,ইন ফ্যাক্ট খুব ভালো। হানিমুনে এসেছি দোস্ত।”
– “সত্যি! কংগ্রাচুলেশনস বন্ধু।”
– “অনেক দিন পর দেখা। তুই কি ট্যুরে এসেছিস?”
মেঘালয় মাথা চুলকে বললো, “হুম ফ্রেন্ড সার্কেল নিয়ে এসেছি। তোর ভাবিও আছে।”
অরণ্য হেসে বললো, “ভাবি কোথায়?”
– “রুমে, ফ্রেশ হচ্ছে। মাত্র বাইরে থেকে ফিরলাম তো। তোর বউকে দেখাবি না?”
– “হোয়াই নট? হাজার হলেও দোস্ত। তোর বউ মানেই তো আমার বউ,আমার বউ মানে তোর বউ।”
মেঘালয় হো হো করে হেসে উঠলো। অরণ্য বললো, “ভাবিকে নিয়ে আমাদের রুমে আয়। এইতো এটাই আমাদের রুম।”
– “ওকে,তুই গিয়ে কফি বানাও। আমরা আসছি।”
অরণ্য হাসতে হাসতে মেঘালয়ের রুমের বিপরীত রুমটায় ঢুকে গেলো। মেঘালয় রুমে ঢুকে দেখলো মিশু গুনগুন করে গান গাইছে আর চুল আচড়াচ্ছে। চুল ঠিকমত মুছতেই পারেনি আর আচড়াচ্ছে দেখে ও রেগে বললো, “তোমাকে ভেজা চুল আচড়াতে বারণ করেছিলাম।”
মিশু মুখ কাচুমাচু করে বললো, “ইস! ভূলেই গিয়েছিলাম।”
– “আচড়েছো ভালো করেছো। এক পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা। চলো ওর বউকে দেখে আসি।”
মিশু উঠে দাঁড়াল। মেঘালয় এগিয়ে এসে তোয়ালে নিয়ে মিশুর চুলগুলো ভালো মত আচড়ে দিয়ে বললো, “কিচ্ছু পারেনা সোনামণিটা। চোখে কাজল দাও।”
মিশু চোখে কাজল দিতে গিয়ে একচোখে মোটা, আরেক চোখে পাতলা হয়ে গেলো। মেঘালয় নিজেই সেটা ঠিক করে দিলো। তারপর শাড়ি পড়িয়ে দিয়ে হালকা মেকাপ করিয়ে একদম পুতুলের মত দেখাচ্ছিলো মিশুকে। মেঘালয় বললো, “উফফ যা লাগছে না। আমার তো মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।”
– “তোমার বন্ধুর আবার মাথা খারাপ যেন না হয়।”
– “সেটাই ভাবছি। এই আমরা তো আবার বের হবো। তাড়াতাড়ি আসো।”
অরণ্য’র দরজায় নক করতেই ও দরজা খুলে অভ্যর্থনা জানালো। মিশু মেঘালয় ভেতরে ঢুকে দুপুরকে দেখে একদম হতবাক! একদম একইরকম দেখতে একটা মেয়েকে ট্রেনে দেখেছিলো ওরা। নতুন বউয়ের সাজে দেখেছিলো। সেই মেয়েটাই কি? নাহ, একটু পার্থক্য আছে। ওই কনের চেয়ে এই মেয়েটা একটু বেশি ফর্সা। ট্রেনে দেখা মেয়েটা একটু শ্যামলা ছিলো। কিন্তু চেহারার গড়নে অদ্ভুত মিল। মেঘালয় ও মিশু একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো।
দুপুর বললো, “বসুন আপনারা।”
মিশু ও মেঘালয় থতমত খেয়ে চেয়ে আছে। মিশু রৌদ্রময়ীর সাথে কথাও বলেছে। কথা বলার সময় মেয়েটার মুখের ভঙ্গি যেমন হয়,এই মেয়েটার ও ঠিক সেরকম হচ্ছে। মিশু হেসে বললো, “ভাবি তো অনেক সুন্দর দেখতে।”
দুপুর হাসার চেষ্টা করলো। মিশু সবার সাথে খুব অনায়াসেই মিশে যায়। ও গিয়ে দুপুরের পাশে দাঁড়িয়ে দুপুরকে রীতিমত জড়িয়ে ধরলো। মেঘালয়ের মিশুর এই জিনিস টাই খুব পছন্দ। সবাইকে দ্রুত আপন করে নেয় মেয়েটা। মিশু হেসে হেসে বললো, “সত্যিই ভাবি আপনি খুব সুন্দর। অরণ্য ভাইয়া কি সুন্দর একটা বউ পেয়েছে!”
অরণ্য হেসে জবাব দিলো, “আপনি কিন্তু একদম পুতুলের মত দেখতে। দেখলেই কোলে নিয়ে আদর করতে ইচ্ছে করে।”
অরণ্য’র মুখে এমন কথা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো মিশু। মেঘালয় ও অরণ্য হেসে উঠলো। মিশু লজ্জায় অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। দুপুর বললো, “সত্যি বলেছে কিন্তু। তোমাকে দেখলেই গাল টেনে দিতে ইচ্ছে করে। একদম খুকুমণি খুকুমণি চেহারা। শাড়ি পড়ে ঠিক রাজকন্যাটি লাগছে।”
মিশু হাসলো। মেঘালয় মাথা চুলকালো লজ্জা পেয়ে। দুপুর মিশুকে বললো, “সরি বোন। তুমি বলে ফেলেছি। আসলে তুমি দেখতে এমন পিচ্চি, আপনি বলতেই ইচ্ছে করেনা। আর এত আপন আপন লাগে, আপনি বলা যায় বলো?”
মিশু দুপুরকে জড়িয়ে ধরে বললো, “তুমি করেই বলুন। আমার ভালো লাগছে শুনতে।”
অরণ্য দু কাপ কফি এগিয়ে দিলো মেঘালয় ও মিশুর দিকে। মেঘালয় সোফায় বসে কফিতে চুমুক দিলো। মিশু দুপুরকে নিয়ে বিছানার উপর বসেছে। অরণ্য ও মেঘালয় হাসাহাসি করছে। মিশু দুপুরকে জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা আপনার কি আপনার মত দেখতে কোনো বোন আছে?”
চমকে উঠলো দুপুর। অরণ্য ও মাথা তুলে তাকালো মিশুর দিকে। কারো মুখে কোনো কথা ফুটছে না। দুপুরের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেলো হঠাৎ।
৪৩.
দুপুরের গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ পড়লো মেঘালয়ের। মেয়েটি দিব্যি হাসিখুশি ছিলো, বোনের কথা জিজ্ঞেস করতেই তার মুখ এমন আষাঢ়ে আকাশের মত হয়ে গেলো কেন? কোনো একটা ব্যাপার নিশ্চয়ই আছে।
মিশু কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে আছে দুপুরের মুখের দিকে। দুপুর দ্রুত চিন্তা করছে কি উত্তর দেবে সে? যদি মিথ্যে বলে তবে ব্যাপারটা বাজে হয়ে দাঁড়াবে। হতে পারে মিশু তার বোনকে কোনোভাবে চেনে। অস্বীকার করলে মিশু ওকে মিথ্যাবাদী ভাব্বে। দুপুর একটু ভেবে উত্তর দিতে যাবে এমন সময় অরণ্য বললো, “না, ওর কোনো বোন নেই।”
মিশু আর কিছু বললো না। দুজনের বিকৃত মুখ দেখেই মনেহচ্ছে ব্যাপার টা গোলমেলে। কোথাও একটা গোপন রহস্য আছে যেটা ওরা লুকাতে চাইছে। অযথা কথা বাড়িয়ে আর লাভ নেই। মেঘালয় ঠিক একই কথাই ভাবছিলো। অরণ্য হানিমুনে এসেছে, তারমানে হয়ত দুদিন আগেই অরণ্য ‘র বিয়ে হয়েছে। ঠিক সেদিন ই বিয়ের কনে পালিয়ে এসে ট্রেনে উঠেছিলো। এদের মাঝে একটা যোগসূত্র নিশ্চয়ই আছে। সেসব আর জিজ্ঞেস করে ওদেরকে বিবৃত করার কোনো মানেই হয়না। ওরা যে মিথ্যে বলছে সেটা দুপুরের গম্ভীর মুখ দেখেই স্পষ্ট হয়ে গেছে।
মেঘালয় কথা ঘুরানোর জন্য বললো, “কবে আসলি এখানে?”
অরণ্য হাসার চেষ্টা করে বললো, “কিছুক্ষণ হলো পৌছেছি। তোরা?”
– “আমরা আজকে সকালেই এসেছি। সারাদিন ঘুরে সন্ধ্যার আগে আগে ফিরলাম। এখন আবার একটু বেরোবো।”
অরণ্য জানতে চাইলো, “এখন কোথায় ঘুরতে যাবি আবার? রাত তো হয়েই এসেছে প্রায়।”
মেঘালয় জবাব দিলো, “একটা কাজ আছে। চা বাগানের মালিকের সাথে মিটিং আছে একটু। ”
অরণ্য মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “ও আচ্ছা। ডিনার তো বাইরেই করবি তাইনা? আমরা একসাথে ডিনার করতে পারি?”
মেঘালয় বললো, “অবশ্যই। আমার সাথে আরো তিনজন ফ্রেন্ড আছে। সবাই একসাথে ডিনার করতে পারবো। তো তোরাও চলনা আমাদের সাথে। একটু ঘুরেফিরে একেবারে ডিনার করেই হোটেলে ফিরবো।”
অরণ্য দুপুরের দিকে তাকিয়ে বললো, “না রে। জার্নি করে এসে টায়ার্ড হয়ে গেছে দুপুর। দুপুরে রাত নেমেছে। এখন আর বাইরে যাবো না।”
দুপুর অরণ্য’র কথার মাঝখানে বলে উঠলো, “আমি একদম ঠিক আছি। রুমে বসে থাকতে বরং ভালো লাগছে না। যাই না ঘুরে আসি? আমি আর ভাবি মিলে গল্প করবো আর আপনারা কথা বলবেন।”
দুপুর নিজে থেকে যেতে চাইছে বলে অরণ্য আর না করলো না। কফি খাওয়া শেষ করে ওরা বাইরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হলো। দুপুর যথাসাধ্য চেষ্টা করছে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য। মিশুর সাথে গল্প করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। তবুও কেন যেন সহজ হতে পারছে না। কিন্তু মিশুর সাথে খুব গম্ভীর মানুষ ও ঠিকই গল্পে মেতে উঠতে বাধ্য। মিশু যে পরিমাণ বকবক করতে থাকে, না চাইলেও মুড আপনা আপনি চালু চলে যায়। দুপুর ও মিশুর রাতারগুলে ভ্রমণের গল্প শুনতে শুনতে উত্তেজিত হয়ে উঠতে লাগলো। দুদিন পর দুপুরকে এরকম স্বাভাবিক ভাবে হাসতে দেখে অরণ্য স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো।
মেঘালয় কে বললো, “তোর বউয়ের শুধু রূপ নয়,গুন ও আছে দেখছি।”
মেঘালয় হেসে হেসে বললো, “আমার বউয়ের কি দেখলি তুই??”
– “আহা! যেটুকু দর্শনীয় সেটুকুই দেখেছি। দ্যাখ আমার বউয়ের সাথে কেমন গলায় গলায় ভাব জমিয়েছে যেন ওরা মায়ের পেটের বোন।”
বলেই শব্দ করে হেসে উঠলো। মেঘালয় ওর কাঁধে হাত রেখে বললো, “ঠিকই আছে। আমরা তাহলে ভায়রা ভাই।”
অরণ্য বললো, “উহু, তোর বউ মানে আমার বউ,আর আমার বউ মানেই তো তোর বউ তাইনা?”
মেঘালয় অরণ্য’র কাঁধে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললো, “উহুম না। তোর বউ মানে আমার বউ,আর আমার বউ মানে তোর ভাবি।”
দুই বন্ধু হো হো করে হেসে উঠলো। মিশু ও দুপুর ওদের ফিসফিস কথাবার্তা আর উচ্চস্বরে হাসতে দেখে ওরাও হাসলো। যাক, ঘুরতে এসে একটু আনন্দ হলে সেটাও অনেক। বাড়িতে থাকলে নিশ্চয়ই সারাক্ষণ কান্না পেত দুপুরের।
গাড়ির কাছে এসে মেঘালয় হাসতে হাসতে বললো, “জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি। একটু চাপাচাপি করে বসতে হবে দোস্ত। কষ্ট হবে না তো?”
অরণ্য বললো, “তোর বউকে তো আমার মানুষ মনেই হয়না।”
মিশু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে অরণ্য’র দিকে তাকালো। মানুষ মনেহয় না মানে? মিশু কি তাহলে?
অরণ্য বললো, “না মানে মিশুকে আমার বারবি ডল বারবি ডল লাগে। ওকে তো অনায়াসে কোলের উপর বসিয়ে নিয়ে যেতে পারিস।”
মিশু লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো। মেঘালয়ের বন্ধুরা অনেক দুষ্টমি করলেও এত বেশি ফাজলামি কখনো করেনা। অরণ্য একটু গভীর টাইপের কথাবার্তা বলে,শুনতে কেমন যেন লাগে। ছেলেটার মুখে কিচ্ছু আটকায় না। মেঘালয় ইয়ার্কির মোক্ষম জবাব দিতে সত্যি সত্যিই মিশুকে কোলে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো। মিশুর ইচ্ছে করলো লজ্জায় মেঘালয়ের বুকের ভেতর ঢুকে যায়। চোখ মেলে তাকাতেই পারছে না ও। মেঘালয় ওকে কোলের উপর বসিয়ে পাশের সিটে অরণ্যকে বসতে বললো। অরণ্য’র পাশে দুপুর বসে পড়লো। সামনের সিটে বাকি তিনবন্ধু বসে গেলো। আরাফ গাড়ি ড্রাইভ করছে। ছোট্ট একটা গাড়ি হওয়ায় বসতে কষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু মেঘালয়ের এই গাড়িটাই খুব পছন্দের।
মিশু মেঘালয়ের কোল থেকে নেমে পাশে বসলো। মেঘালয় ওর চোখের দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেলো। মিশু চোখ রাঙাল ওকে। কিন্তু মেঘালয়ের দৃষ্টি খুব গভীর। ভেতরটা কেঁপে উঠলো মিশুর। ও দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো।
গন্তব্যস্থলে পৌছে গাড়ি থেকে নেমে মিশু ও দুপুরকে একটা টেবিলে বসতে বলা হলো। ওরা দুজন সেখানে বসে কফি খেতে খেতে গল্পে মেতে উঠলো। আর মেঘালয় ও ওর বন্ধুরা তাদের জরুরি আলাপ সারতে অন্য টেবিলে মিটিং এ বসে গেছে। অরণ্য’র যদিও কোনো কাজ ছিলোনা, তবুও ও মেঘালয়ের সাথেই সেখানে বসেছে। ওরা কথা বলছিলো আর অরণ্য ফাঁকে ফাঁকে বারবার আড়চোখে তাকাচ্ছিলো দুপুরের দিকে। দুপুর সেটা বুঝতে পেরে মাথা নিচু করে রইলো। ও মিশুর সাথে মিশে গিয়ে বিভিন্ন ব্যাপার নিয়ে কথা বলছে। মিশু মেয়েটা অনেক ইন্টারেস্টিং ক্যারেকটার বলা যায়। জগতের যত সব অদ্ভুতুড়ে কথাবার্তা ওর মগজে কিলবিল করে। সেসব বলে বলে অন্যের মাথা ধরিয়ে দেয় ও। শুনতে যে খারাপ লাগে তাও না, বরং বেশ মজা লাগে সেসব আজগুবি কথাবার্তা। সচরাচর এমনটা তো দেখা যায় না। দুপুর ও মেতে উঠলো ওর সাথে। আস্তে আস্তে মন খারাপ ভাবটা কেটে যেতে আরম্ভ করেছে।
মিটিং শেষ হলে রেস্টুরেন্ট এ চলে এলো ওরা। খাবার টেবিলে বসেও মিশু ও দুপুর গল্প করছিলো। মেঘালয় মিশুর বকবকানি শুনে হাসছে আর ভাবছে, মেয়েটা আজীবন যেন এমনি থাকে। খাবার চলে এলে ওরা খেতে আরম্ভ করলো। মিশু হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা তোমরা কেউ ব্যাঙ খেয়েছো?”
মেঘালয় কেশে উঠলো, “ব্যাঙ কেউ খায় নাকি?”
মিশু উৎসাহ নিয়ে বললো, “কেন? বর্ষাকালে আমাদের এলাকায় বাড়ির আশেপাশে কত ব্যাঙ পাওয়া যায়। আমরা সেগুলা ধরে ধরে রান্না করে খাই। এত্ত টেস্ট লাগে, ইয়াম্মি।”
সবাই হেসে উঠলো ওর কথা শুনে। পূর্ব ফাজলামি করে বললো, “মঙ্গা এলাকার লোকরা আরো কত কিছুই খাবে।”
মিশু ক্ষেপে গিয়ে বললো, “আমাকে মোটেও মঙ্গা এলাকার লোক বলবা না।”
– “মঙ্গা এলাকার লোকেদের কি বলবো তাহলে? সারাবছর খরা আর দূর্ভিক্ষ লেগেই থাকে।”
– “রংপুর সবচেয়ে শান্তির এলাকা। আমাদের এলাকার মানুষ খুব সরল আর মানুষকে খুব ভালোবাসতে পারে। সাজেক থেকে ঘুরে এসে তোমাদের সবাইকে আমি রংপুর নিয়ে যাবো। দেখে এসো আমাদের গ্রামের মানুষ গুলি কত সরল।”
পূর্ব হেসে বললো, “ব্যাঙ খেয়ে খেয়ে সরল হয়েছে তাইনা?”
মেঘালয় বললো, “মিশুকে ক্ষেপাচ্ছিস কেন তুই?”
– “ক্ষেপালাম আর কোথায়। সত্য কথাই বলেছি। দূর্ভিক্ষ এলাকার লোক। সে সবসময় বিজনেস প্লান মাথায় নিয়ে ঘোরে। রাতারগুলে গিয়েও চাটনি বেচে আর বলে এক পিছ তিন টাকা। সেটা আবার ফ্রিতে দিয়ে বলে,এমনি দিছি। এমনির আরেক নাম তিন টাকা।”
সবাই মুখ টিপে হাসলো।
সায়ান বললো, “তোর মত গুবলেট নাকি? সে সারাক্ষণ বিজনেস প্লান নিয়ে ঘোরে, তার মগজ অলটাইম সক্রিয়। তোদের মত না। তোরা শালা ইচ্ছেকৃত ভাবে আমার ব্রেকাপ ঘটালি।”
সবাই অবাক হয়ে তাকালো। মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, “ব্রেকাপ হয়ে গেছে সিরিয়াসলি?”
সায়ান মুখ কাচুমাচু করে বললো, “হুম। হয়ে গেছে। সন্ধ্যায় কল দিয়েছিলাম, বললো তুই তোর ফ্রেন্ড সার্কেল নিয়াই থাক। গালি দিয়ে আমার চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করেছে। আমিও যা বলার বলেছি।”
আরাফ বলল, “আমাকে তোর থ্যাংকস জানানো উচিৎ। তোকে আমি ফকির হওয়ার হাত থেকে বাঁচাইছি।”
মেঘালয় বললো, “দোস্ত মন খারাপ করিস না। সাজেক থেকে ফিরে মিশু আমাদের রংপুর নিয়ে যাবে। সেখানকার সহজ সরল হাবাগোবা মেয়েদের মধ্যে একটাকে বেছে নিস। আজীবন তোকে মাথায় তুলে রাখবে। আমার একটা সুইট শালীকাও আছে।”
মিশু ক্ষেপে কাটা চামুচ তুলে মেঘালয়ের মুখের সামনে ধরে বললো, “তুমি বলতে চাচ্ছো আমি সহজ সরল হাবাগোবা মেয়ে?”
– “নাহ, আমি বলতে চাচ্ছি রংপুরের সব মেয়েই হাবাগোবা, শুধু আমার বউটা বাদে।”
সবাই শব্দ করে হাসলো। পূর্ব বললো, “ঠিকই বলছিস তবে উলটা করে। সঠিক উত্তর হবে, রংপুরের সব মেয়েই চতুর শুধু তোর বউটাই হাবাগোবা।”
এরপর টেবিল সুদ্ধ সবাই হাসাহাসি শুরু করে দিলো। রেস্টুরেন্টের অন্য টেবিলে বসা লোকজনরা ওদের দিকে তাকাচ্ছে অবাক হয়ে। কত সুন্দর হাসাহাসি করতে করতে খাবার খাচ্ছে ওরা। সাথে আবার চারজন সদ্য বিবাহিত তরুণ তরুণী! আহা! কি সুখী ওরা!
সবাই যখন হাসছিলো মেঘালয় সবার অগোচরে এক হাত দিয়ে মিশুর কোমরে হাত রেখে ওকে একটু কাছে টেনে নিলো। কানের কাছে এগিয়ে ফিসফিস করে বললো, “তোমাকে আজ এত আকর্ষণীয় লাগছে কেন? আমিতো চোখ ফেরাতে পারছি না।”
মিশু মুখ বাঁকা করে ফিসফিস করেই জবাব দিলো, “আমি তো সহজ সরল হাবাগোবা মেয়ে। আমাকে আবার সুন্দর লাগে?”
– “তোমার সরলতার জন্যই তুমি পবিত্র দেখতে। কিন্তু আজকে কেন জানি খুব বেশি স্মার্ট দেখাচ্ছে তোমায়। সবার চেয়ে আকর্ষণীয় লাগছে। স্বর্গ থেকে নেমে আসা পরী মনেহচ্ছে। আমার তো মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।”
– “থাক, বাড়াবাড়ি রকমের কিছু বলতে হবেনা। গুতো মেরে সরি বলতে এসেছে। মন ভুলানো হচ্ছে?”
মেঘালয় ফিসফিস করে বললো, “সত্যিই তোমাকে একদম এত্ত বেশি সুন্দর লাগছে যে তোমার ভাষায় খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে খরছে।”
– “আমি মোটেও অতটা সুন্দরী নই।”
– “যেমন আছো, তাতেই তো আমার মাথা ঘুরপাক খাচ্ছে।”
– “কই? আমিতো ঠিকই দেখতে পাচ্ছি মাথা সোজাই আছে। ঘুরছে না তো।”
মেঘালয় মিশুর কোমরে আলতো চাপ দিয়ে গভীর ভাবে ওর চোখের দিকে তাকালো। ফিসফিস করে বললো, “আজকে হোটেলে ফিরে তোমার খবর ই আছে।”
মিশুর সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো। মেঘালয় মিশুকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে বসে খেতে আরম্ভ করলো। কিন্তু মিশু আর একটুও খেতে পারছে না। রীতিমত পা কাঁপছে। মেঘালয়ের গভীর দৃষ্টি একদম হৃদয়ে পৌছে গেছে ওর। টেবিলের নিচে সবার আড়ালে মেঘালয় মিশুর পায়ের উপর পা রাখলো। আরো কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলো মিশু। কিন্তু যখন ই পা একটু সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে, মেঘালয় আঙুলের ফাঁকে আঙুল ঢুকিয়ে পায়ের পাতা দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে ওর পা। মিশুকে খুব ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। লাজুক রাঙা হয়ে উঠেছে ওর মুখটা। খাবার তুলে মুখে দেয়ার মত শক্তিটাও পাচ্ছেনা। মেঘালয় এমন কেন?
দুপুর মিশুর পাশেই বসেছে। এদিকে সবাই নানান রকম ইয়ার্কি ফাজলামি করছে আর হাসছে। দুপুর একবার নিচের দিকে তাকাতেই মিশু ও মেঘালয়ের পায়ের খেলা চোখে পড়লো ওর। মিশু পা সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেও পারছে না। পায়ে পা রাখার অনুভূতি ও এত সুখকর হতে পারে সেটা ও প্রথম অনুধাবন করলো আজ। দুপুর কয়েক পলক সেদিকে তাকিয়ে অস্থির হয়ে উঠলো। অন্যরকম কষ্ট অনুভূত হচ্ছে ওর। মিশুর বয়স মাত্র আঠারো। একজন সদ্য বেড়ে ওঠা তরুণী হিসেবে খুব সুখী ও। একইসাথে মিশু একজন পরিপূর্ণ প্রেমিকা, একজন স্ত্রী, একজন অর্ধাঙ্গিনী। দুপুরের ও ইচ্ছে করছে মিশুর মত সুখী হতে। একজন প্রেমিকা হতে, একজন স্ত্রী হতে। আজ যদি অরণ্য’র জায়গায় নিখিল থাকতো, তবে দুপুর ও নিঃসন্দেহে মিশুর মত উচ্ছল থাকতো। এসব ভেবে একবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো ও।
সায়ান মিশুর প্লেটের দিকে চেয়ে বললো, “ম্যাশ ভাবি তো কিছুই খাচ্ছেন না। ওনাকে অমন দেখাচ্ছে কেন? কোনো সমস্যা?”
মিশু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো কিন্তু তবুও ওকে ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিলো। মেঘালয় বললো, “তোমার ম্যাশ ভাবি গভীর ভাবে কিছু চিন্তা করছে।”
– “কি হইছে ওর? কিসের চিন্তা?”
মেঘালয় মুখ টিপে হেসে জবাব দিলো, “সে চিন্তা করছে টেবিলের নিচে সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে কিনা।”
মিশু এই কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারলো না। কিন্তু মেঘালয়ের বন্ধুরা সবাই আরেক দফা হেসে নিলো এটা নিয়ে। সবাই হাসছে তো হাসছে ই। কারো আর হাসি থামছে না। মিশু মনেমনে ভাবছে, সবাই খুব খারাপ। শুধু হাসাহাসি করে ওকে নিয়ে। আর খুব পঁচা পঁচা ফাজলামি করে। আজকালকার দিনের ছেলেরা খুব সাংঘাতিক। মারাত্মক রকমের ইয়ার্কি করে শুধু।
হোটেলে ফেরার সময় পর্যন্ত সবাই হাসি ঠাট্টা করতে লাগলো। ফিরে এসে যে যার রুমে চলে গেলো। মিশু রুমে এসে বসে আছে, মেঘালয় ওকে রেখে একটু পূর্বদের সাথে কথা বলতে গেছে। কালকেই এই হোটেল ছেড়ে দেয়া হবে। আগামী দুদিন ওরা চা বাগানের বাংলোয় থাকবে। সেসব নিয়ে কথা বলে এসে রুমে ঢুকলো।
রুমে ঢুকতেই মিশু মেঘালয়কে জিজ্ঞেস করলো, “আমার এত ঘোর ঘোর লাগে ক্যান মেঘমনি?”
চলবে..