অনুভূতি
পর্ব -২৪
মিশু মনি
অনুভূতি সকল পর্ব
অনুভূতি ! পর্ব_১
অনুভূতি ! পর্ব_২
.
মিশু ফ্রেশ হয়ে এসে রেডি হয়ে নিলো। মেঘালয় বালিশ থেকে মুখ তুলে দেখলো মিশু চুল আচড়াচ্ছে। এতক্ষণ খেয়াল ই করেনি মেঘালয়, মিশুর লম্বা চুলগুলো কেটে ছোট ছোট করে ফেলেছে। মেঘালয়ের মেজাজ প্রচণ্ড গরম হয়ে গেলো। এত সুন্দর চুলগুলোর এই অবস্থা করে ফেলেছে!
মেঘালয় উঠে এসে মিশুকে হেচকা টানে বুকের উপর টেনে নিলো। তারপর রেগে বললো, “এই কয়েকদিন কিচ্ছু বলিনি তোমায়। তোমার চুল স্বপ্নে দেখে তোমার প্রেমে পড়েছি আমি। আর তোমার চুলের এই হাল কি করে হলো?”
মিশু মেঘালয়ের বাহুর বন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে করতে বললো, “সবসময় চুল লম্বাই ছিলো। একটু ছোট করে দেখলাম কেমন দেখায়।”
– “চুল কাটার আগে আমার পারমিশন নিয়েছিলে?”
– “হেয়ার কাটিং এর জন্য পারমিশন কেন নিতে হবে?”
মেঘালয়ের আরো রাগ উঠে গেলো। ও মিশুকে দুহাতে চেপে ধরে বললো, “জানিস না তোর চুলের প্রতি আমার কত দূর্বলতা? কতবার করে বলেছি যেন আজীবন তোমার চুলের ঘ্রাণ এমনই থাকে। সবসময় চুলগুলো এমনই রেখো। আর তুমি চুল ছোট করে ফেলেছো,আবার কালার ও করেছো?”
মিশু বললো, “কক্ষনো করিনি। তাই ইচ্ছে করলো করতে।”
– “তুমি কখন পার্লারে যাও সেটাও আমাকে বলোনা। আমিতো তোমার চুল না দেখলে বুঝতেই পারতাম না তুমি আজকাল পার্লারে যাও।”
– “পার্লারে যাওয়াটা কি দোষের?”
– “মেঘালয়ের বউ পার্লারে কেন যাবে?”
– “আজব কথা বললে।”
– “হ্যা বললাম। কারণ আমার বউ কখনো পার্লারে যাবেনা, প্রয়োজনে পার্লার থেকে বিউটিশিয়ান নিজে আমার বাসায় এসে আমার বউকে সার্ভিস দেবে। আমি কখনোই চাইনি তুমি চুল কেটে কালার করে এতটা মডার্ন হয়ে যাও। তোমার ন্যাচারাল লুকটার জন্যই আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
– “এখন কি ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে না?”
মেঘালয় বললো, “ইচ্ছে করছে তোমাকে কামড়ে শেষ করে ফেলি। কতদিন থেকে সারাক্ষণ ব্যস্ততার অজুহাত দেখাচ্ছো। আমি কিচ্ছু বলিনি। তুমি সপ্তাহে একদিন আমাকে সময় দিলেও আমার আপত্তি নেই। যাতে তুমি ভালো থাকো সেটাই করো। কিন্তু তুমি নিজেকে চেঞ্জ করে ফেলবা আমি সেটা মানতে পারবো না। মাসে একবার দেখা হলেও তোমার পবিত্র আর বিশুদ্ধ ন্যাচারাল চেহারাটা দেখতে চাই আমি।”
মিশু এবার গায়ের জোরে মেঘালয়ের হাতের বন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। মেঘালয়ের রাগ এখনো কমছে না। কিন্তু মিশুকে কিছুই বলতে পারছে না ও। রাগে নিজের মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে করছে ওর। বদলানো মানে একেবারে চেহারাও বদলে ফেলেছে! এটা কিভাবে সম্ভব!
মিশু বললো, “শান্ত হও মেঘ। এত রেগে যাবে আমি বুঝতে পারিনি। ভেবেছিলাম তুমি খুশিই হবে। কিন্তু আমার সব কাজে তুমি খুশি হওনা,সেটা আমার জানা ছিলোনা।”
মেঘালয় মিশুর সামনে এসে চোখে চোখ রেখে বললো, “তোমার সব ইচ্ছে পূরণ করতে নিজের জীবনটাও দিয়ে দিতে পারি আমি। কিন্তু তুমি নিজেকে বদলে ফেলো না প্লিজ। দোহাই লাগে তোমার।”
– “আমি একটুও বদলাইনি মেঘ। তুমি আমায় ভূল বুঝছো। আমাকে আগের মত ভালোবাসার চোখে দেখো, দেখবে আমি একটুও বদলাইনি।”
– “তুমি ইদানীং ওয়েস্টার্ন ড্রেস পড়তে শিখেছো?”
– “এটা নিয়েও তোমার অভিযোগ? যেখানে চলাফেরা করি,সেখানে পড়তেই হয়। তোমার চেয়ে ভালো কে জানে? একটা পার্টিতে কি আমি কামিজ স্যালোয়ার পড়ে যাবো?”
– “নিজের স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলো না মিশু। তুমি যেমন ছিলে,তাতেই তোমাকে আর সবার থেকে অনন্য আর সুন্দর লাগতো। অন্যকে নকল করে সুন্দরী হওয়া যায়না।”
মিশু রেগে বললো, “আমি কাউকে নকল করছি না। আমার যেটা পড়তে বা যা করতে কমফোর্ট ফিল করবো, আমি সেটাই পড়বো। এতে কাউকে নকল করার কথা কেন আসছে মেঘ?”
মেঘালয় আর কিছু বললো না। এভাবে মিশুকে বোঝানো সম্ভব না। ওকে ধীরেসুস্থে ঠাণ্ডা মাথায় বুঝিয়ে বলতে হবে। কিন্তু মিশু তো দ্রুত রেডি হচ্ছে বাইরে যাওয়ার জন্য। মেঘালয় কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। মিশু আয়নার সামনে সাজগোজ করছে। মেঘালয় একটু ভেবে এগিয়ে এসে ওকে পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরলো। মিশুর পেটে হাত রেখে বলল, ” আমি বলেছিলাম না রেগুলার ইয়োগা করলে তোমার ফিগার দেখে যেকোনো ছেলের মাথা ঘুরে যাবে। দেখেছো পেটটা কত স্লিম লাগছে?”
মিশুর রাগ নিমেষেই কমে গেলো। ও আয়নার দিকে তাকিয়ে বললো, “সত্যি বলছো?”
মেঘালয় হেসে বলল, “হুম আমার পাগলী টা। কিন্তু একটু মেদ থাকলেই তোমায় সুন্দর দেখাতো, নাভীটা একদম কুয়ার মত লাগতো আগে।”
মিশু মুচকি হেসে বললো, “হা হা হা। সবার তো স্লিম ফিগার পছন্দ। তোমার আবার হালকা মেদ ভালো লাগে?”
– “তুমি আমার সেরা সুন্দরী ছিলে বুঝলে? এখনো ভালোই লাগছে। কিন্তু আগে তোমাকে ন্যাচারাল লাগতো ”
– “এখন কি প্লাস্টিক প্লাস্টিক লাগে?”
– “স্ট্যাচু স্ট্যাচু লাগে। হা হা হা।”
মিশু হেসে বললো, “ছাড়ো তো। রেডি হতে দাও।”
মেঘালয় মিশুর কাঁধে মাথা রেখে ওর গালে গাল ঘষে ছোট ছোট দাড়ির হালকা খোঁচা দিয়ে বললো, “তোমার গায়ের স্মেলটা দারুণ মিশু।”
মিশু শিহরিত হয়ে উঠলো। মেঘালয়কে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো, “এখন দুষ্টুমি না। আমার রিহার্সাল আছে।”
– “যাবে তো। একটু ভালোবাসতে দাও। তোমাকে দেখলে একদম ই দূরে থাকা যায়না। বড্ড আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছো। পাগল হয়ে যাচ্ছি।”
– “মেঘ,তুমি এই অসময়ে কেন এলে? আমার কাজ আছে।”
– “একটু পরে গেলে কিছু হবেনা। রেগুলার তো আর আসিনা, কতদিন পরে এলাম।”
– “উফফ পেটে এভাবে হাত বুলাচ্ছো কেন মেঘ? অস্থির হয়ে উঠছি তো।”
– “অস্থির করতেই চাইছি। এখন তোমার কোথাও যাওয়া হবেনা। এখন আমার মাঝে মিশে যাবা তুমি।”
– “বাচ্চাদের মতন করোনা তো। আমার একটা প্রোগ্রাম আছে। কিছু ডায়ালগ মুখস্থ করতে হবে আমায়।”
মেঘালয় বললো, “সব হবে। পরে যেও। আমাকে কেন এত দূরে সরিয়ে রাখো বলোতো? এরকম একটা বউকে রেখে কি দূরে থাকা যায়?”
মিশু হাসার চেষ্টা করে বললো, “কাজের সময় দুষ্টুমি?”
মেঘালয় মিশুর টপসের নিচ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে ওর পেটে চাপ দিতে দিতে বললো, “কতটা চেঞ্জ হয়ে গেছো তুমি। আজকাল আর লজ্জায় নীল হয়ে যাওনা। আগে যদি এভাবে বলতাম তাহলে বলতে, তুমি একটা খুব খারাপ। সেই কথাটা শুনতে এত ভালো লাগতো আমার! আমার বুকে মুখ গুঁজে দিয়ে লজ্জায় মরে যেতে। দুটো কিল বসাতে আমার বুকে। বড্ড মিস করি সেইসব দিনগুলোকে!”
মিশু কিছু বললো না। নিজের বদলে যাওয়ার কথাগুলো শুনতে শুনতে আর মেঘালয়ের পাগল করা স্পর্শে অস্থির হয়ে উঠতে লাগলো। মেঘালয় আস্তে আস্তে পিছনে সরে এসে মিশুকে বুকে জড়িয়ে ধরেই বিছানায় শুয়ে পড়লো। মিশুর জিন্সের ভেতর দিয়ে ওর তলপেটে হাত রাখলো। মিশুর ঘোর ঘোর লেগে যাচ্ছে। মেঘালয় মিশুর পায়ে পা রেখে আলতো করে ছুঁয়ে দিতে লাগলো। মিশু উত্তেজনায় ছটফট করতে শুরু করেছে। ছেলেটা এত দুষ্টু,এমন ভাবে ঘায়েল করে ফেলে যে নেশা ধরে যায়। এমন সময় মিশুর ফোন বেজে উঠলো।
মিশু ওঠার চেষ্টা করতেই মেঘালয় ওকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হলো। মিশু ফোন রিসিভ করে বললো, “হ্যালো”
ওপাশ থেকে কি বললো বোঝা গেলো না। মিশু বললো, “আচ্ছা আমি এক্ষুণি আসছি।”
ফোন রেখেই বললো, “সরি মেঘ। আমাকে যেতে হবে এখন। শিল্পকলায় একটা ফটোগ্রাফি এক্সিবিশন অনুষ্ঠানে উপস্থাপনা করতে বলেছে। আমি এখনো ফাইনালি জানাইনি কিছু। প্রধান অতিথি হাসানুল হক ইনু। সে কারণেই ইচ্ছে করছে প্রোগ্রামটা করি। এখান গিয়ে একটু দেখে আসতে হবে কি ব্যাপার।”
মেঘালয় কিছু বললো না। আজকাল এতকিছু করছে ওকে কিছুই জানানোর প্রয়োজন মনে করেনা মিশু। অযথা বলেই বা কি হবে। সে যাই করুক,এই অবস্থায় মেঘালয়কে ফেলে গেলে সেটা খুবই কষ্টদায়ক হবে মেঘের জন্য। ও সহ্য করতে পারবে না এরকম আচরণ। যাকে সবটুকু উৎসর্গ দিতে পারে,যার জন্য দিনরাত একাকার করে পরিশ্রম করে যাচ্ছে সেই মেয়েটাকে যদি একটু ভালোবাসতে না পারে এরচেয়ে বড় কষ্ট আর কি হতে পারে?
মিশু বললো, “তুমি কি যাবে? না গেলে তোমার কোনো কাজ না থাকলে বাসায় থাকো। আমি তাড়াতাড়ি ফিরবো।”
মেঘালয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সারপ্রাইজ দিতে এসে নিজেই বারবার সারপ্রাইজড হয়ে যাচ্ছে। এতকিছু কল্পনাও করেনি ও। এত দ্রুত এত বিশাল সব পরিবর্তন সত্যিই মেনে নেয়ার মত নয়। মেঘালয় দুহাতে মুখ ঢেকে বিছানায় বসে রইলো। মিশু সেদিকে খেয়াল ও করলো না। ফ্রেশ হয়ে এসে আরেকবার চুলগুলো আচড়িয়ে নিয়ে ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলো। দরজার কাছে গিয়ে বললো, “আমি আসছি। জরুরি কাজ না থাকলে আজকে থেকে যাও।”
কথাটা বলেই চলে গেলো মিশু। মেঘালয়ের বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। জরুরি কাজ থাকলেও মিশু একবার বললে সবকাজ ফেলে ওকে সময় দিতো মেঘ। মিশুর খুশির জন্য সবই করতে পারবে ও। আজকে যদি ওর জায়গায় মিশু থাকত, আর মেঘালয়ের যদি সরকারি চাকরীও হতো তবুও মিশুর ভালোলাগার জন্য ডিউটিতে যেতো না ও। চাকরী জলে যাক,মিশুর প্রশান্তি আগে। যে মিশুর জন্য এতটা ভালোবাসা বুকে নিয়ে আজকে ওকে বিয়ের কথাটা বলবে বলে এসেছে,সে মিশু ওকে পাত্তাই দিলোনা। এতটা কাছে পাওয়ার পর এভাবে ফেলে চলে গেলে মানুষের মাথা ঠিক থাকার কথা না। সেখানে মেঘালয় ওকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসে,মেঘালয়ের মনের অবস্থা সাংঘাতিক রকমের খারাপ হলো। ও বিছানায় শুয়ে রইলো চুপচাপ।
৭৬.
মিশু সন্ধ্যার পরপর ই ফিরলো। বুয়া এসে রান্না করে দিয়ে গেছে। মেঘালয় বিছানা ছেড়ে ওঠেনি। শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। ঘুম ভাঙার পর শুয়েই আছে। মিশু এসে বিছানার পাশে বসে বললো, “ঘুম হলো? ওঠো, নাস্তা করো।”
মেঘালয় কিছু বললো না। চোখ মেলে তাকালো মিশুর দিকে। মিশুকে খুবই স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। বাসায় ফিরে আবার শাওয়ার নিয়েছে বোধহয়। ভেজা চুল থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। দুপাশের সামনের কাটা চুলগুলো মুখের উপর এসে পড়েছে। মেঘালয় অনেক্ষণ তাকিয়ে রইলো মিশুর মুখের দিকে। এই মেয়েটাকে ছাড়া ও বাঁচবে কি করে?
মিশু বললো, “কি দেখছো অমন করে? ওঠো, ফ্রেশ হয়ে এসে নাস্তা করবে। আমিতো ভেবেছিলাম তুমি চলে গেছো। যাক,থেকে গিয়ে ভালোই করেছো। কতদিন কাছে পাইনা তোমায়।”
মেঘালয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, “দুপুরে ওভাবে আমাকে তাচ্ছিল্য করে ফেলে রেখে গেলে। এখন আবার এটা বলছো?”
– “মেঘ,আমি কাজ ছিলো বললাম না। সবকিছুর একটা সময় থাকে।”
– “হুম,আমার জানা ছিলোনা। সরি।”
– “রাগ করছো কেন? কাল আমার অফডে। আজকে সারারাত দুজনে জেগে জেগে গল্প করবো। এখন উঠবে কি?”
মেঘালয় উঠে ফ্রেশ হয়ে আসলো। রাত নেমেছে। চা খেতে খেতে বললো, “নতুন নতুন কাজ করছো। আমাকে জানাও না কিছু।”
– “ব্যস্ততার কারণে জানানো হয়না।”
– “জগতে ব্যস্ততা বলে কিছু নেই। সবই গুরুত্বের উপর নির্ভর করে। আমি কঠিন ব্যস্ততার সময়েও তোমাকে সময় দিয়েছি।”
– “তারমানে বলতে চাইছো আমি তোমায় গুরুত্ব দিইনা?”
মেঘালয় নিশ্চুপ রইলো কিছুক্ষণ। তারপর বললো, “একটা সারপ্রাইজ দিতে এসেছিলাম তোমায়।”
– “হুম বলো।”
মেঘালয় চায়ে চুমুক দিয়ে বললো, “আগামী দশদিনের মধ্যে আমাদের বিয়ে হচ্ছে।”
মিশু চমকে উঠে বললো, “বিয়ে মানে! কিসের বিয়ে?”
মেঘালয় বললো, “আমাদের বিয়ে। আব্বু আম্মু চাইছে তোমাকে বিয়ে করে বাসায় তুলতে। ভেবেছিলাম আরো তিন চার বছর পর বাসায় তুলবো। ওরা চাইছে যখন দেরি করে লাভ কি? আমাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকীর দিনেই আমরা আরেকবার বিয়ে করবো। কি বলো?”
মিশু অবাক হয়ে চেয়ে আছে। মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “সম্ভব না। কিছুতেই সম্ভব না।”
মেঘালয় অপ্রস্তুত হয়ে তাকালো মিশুর দিকে। ভেবেছিলো মিশু খুশিতে ওকে জড়িয়ে ধরবে। কিন্তু মিশু এরকম বলবে সেটা ও ভাবতেও পারেনি। অদ্ভুত লাগছে।
মিশু বললো, “এত তাড়াতাড়ি আমি সংসারে জড়াতে পারবো না। আগে নিজের মত করে লাইফটা এনজয় করি,ক্যারিয়ার গোছাই তারপর।”
– “তোমার লাইফে আমি ছাড়া আর কি আছে? সবই হবে,আমাদের ভালোবাসার স্বীকৃতি পেয়ে সব করবে।”
– “সংসার একটা ঝামেলার জিনিস। আমি এখন ই পারবো না।”
– “তোমাকে কোনো ঝামেলা করতে হবেনা। আমাদের বাসায় তোমার কোনো দায়িত্ব নেই,শুধু আমাকে ভালোবাসবে”
– “এখনি না মেঘ। আরো কিছুদিন সময় যাক তারপর। এত তাড়াতাড়ি কেন?”
– “তুমিই আগে বলতে কবে বাসায় তুলবো? আজ এটা বলছো?”
– “হ্যা,কারণ মাত্র ক্যারিয়ার শুরু হচ্ছে আমার।”
– “উফ ক্যারিয়ার রাখবে তুমি? আমার বিজনেস পুরোটাই তোমায় দিয়ে দিবো, সব তোমায় দিয়ে দিবো, সব। তুমি জনপ্রিয় Rj হয়েছো, টিভিতে উপস্থাপনা করছো। আর কি চাও?”
মিশু অবাক হয়ে গেলো মেঘালয়ের ঝাঁঝালো কথা শুনে। বললো, “একটু নিজের মত এনজয় করতে দাও।”
– “তোমার এনজয় করার জন্য তোমার আমাকে বাদ দিতে হবে? আমার সাথে কতদিন ভালোমতো কথা বলোনা তুমি?”
– “মেঘ,একটু বুঝার চেষ্টা করো। এত তাড়াতাড়ি সংসার পারবো না আমি।”
মেঘালয় উঠে এসে মিশুর পায়ের কাছে বসে ওর কোলে মাথা রেখে বললো, “তুমি একটু বোঝার চেষ্টা করো মিশু। আমি একদমই তোমাকে ছাড়া থাকতে পারিনা। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। আর তোমাকে নিয়ে আজকাল খুব চিন্তা হয়। তুমি ইদানীং বেপরোয়া ভাবে চলাফেরা করো। আমাদের বাসায় থাকলে একটু শাসনে থাকবা,আমার সাথে বের হবা সবসময়। আমার চিন্তা থাকবে না।”
– “তোমার সাথে সবসময় বের হতে হবে? আমার স্বাধীনতা কেড়ে নিতে চাইছো তুমি?”
– “এটা কি বললা মিশু? আমি তোমাকে স্বাধীনতা দিচ্ছি,সবসময় আমার সাথে রাখতে চাইছি আর তুমি বলছো?”
– “হ্যা। আমার স্বাধীনতা কেন কেড়ে নিতে চাও তুমি? আমাকে একটু স্বাধীন ভাবে থাকতে দিবানা?”
মেঘালয় মিশুর কোল ছেড়ে দিয়ে মেঝেতে পা মেলে দিয়ে বসে পড়লো। মিশুর মুখ থেকে এমন কথা একদম ই আশা করেনি ও। বুকটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে মাটির ভেতর ঢুকে যেতে। কি বলবে বুঝতে না পেরে নিশ্চুপ হয়ে রইলো। এমন সময় ফোন বেজে উঠলো ওর। মা ফোন দিয়েছে। রিসিভ করে বললো, “হ্যা আম্মু বলো।”
মা বললেন, “বাসায় আসবি একটু তাড়াতাড়ি? তোর আব্বু একটু তাড়াতাড়ি আসতে বলেছে। একসাথে ডিনার করবো। জলদি আসিস।”
মেঘালয় “আচ্ছা” বলে রেখে দিলো। ভালোই হলো। এই মুহুর্তে মিশুর সামনে বসে থাকলে মিশুর তিক্ততা আরো বেড়ে যেতো। আর ওরও খারাপ লাগতো খুব। তারচেয়ে এখন বাসায় চলে যাওয়াটাই ভালো হবে। ভেবেচিন্তে সবকিছু ঠিক করে ফেলতে হবে।
মেঘালয় মায়ের কথাটা মিশুকে বলে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। মিশু একবার থাকতেও বললো না। ঠায় বসে রইলো সোফায়। মেঘালয় বুক ভরা যন্ত্রণা নিয়ে বেড়িয়ে এলো বাসা থেকে। ছেলেদের নাকি কখনো কাঁদতে নেই,যদি চিৎকার করে একবার কাঁদতে পারতো!
৭৭.
খাবার টেবিলে বাবা চারটা কার্ড দেখিয়ে বললেন, “ইনভাইটেশন কার্ড। ডিজাইন গুলো মিশুকে দেখিয়ে একটা সিলেক্ট করিস।”
মেঘালয় চমকে উঠলো কার্ড দেখে। একদিনের মধ্যে বাবা কার্ডও পছন্দ করে ফেলেছে! আসলে বাবা মা ওকে খুবই ভালোবাসেন,তাই ছেলেকে সারপ্রাইজ দিতেও ভালোবাসেন। কিন্তু মিশু তো এখনি কিছুতেই বিয়ে করতে চাইছে না, এটা বাবা মাকে কিভাবে বলা সম্ভব?
বাবা বললেন, “আমি এদিকে যা যা করতে হয় সবই ভেবেচিন্তে ঠিক করে ফেলবো। যেহেতু আমাদের আর নিজস্ব লোক নেই,আমাদেরকেই সব ব্যবস্থা করতে হবে। তোর কাজিনদের ডাকবি, আমি তোর চাচা আর মামাদের ফোন দিয়ে জানিয়ে দিয়েছি। এখন তোর প্রথম কাজ হচ্ছে একজন ভালো ওয়েডিং প্লানারকে সিলেক্ট করা।”
মেঘালয় অবাক হয়ে বললো, “আব্বু! এসব কি বলো? এত দ্রুত এতকিছু করে ফেলেছো?”
বাবা বললেন,”হুম। কারণ আমার একটাই ছেলে,কিন্তু আমাদের রিলেটিভ আর ফ্রেন্ড সার্কেল অনেক। বিয়ে তো একবার ই হবে,আমি চাই আগামী দুদিনের মধ্যেই সব আত্মীয় স্বজন আমাদের বাসায় চলে আসুক। এক সপ্তাহ ধরে আনন্দ চলুক বিয়ের। আকাশ আহমেদের ছেলের বিয়ে বলে কথা। এক সপ্তাহ বাসায় লাইট জ্বলবে,হৈ চৈ হবে। তবেই না বিয়ে বাড়ি বিয়ে বাড়ি মনেহবে।”
মেঘালয়ের বুকটা চিনচিন করতে শুরু করেছে। মিশু যদি আগের মত থাকতো তাহলে আজকের এই কথাগুলো শুনলে ওর সুখে মরে যেতে ইচ্ছে করতো। বাবা মা ওকে নিজের মেয়ের মত মনে করে। ওনারা কত কিছু প্লান করে ফেলেছেন। এখন কিভাবে বাধা দেবে মেঘালয়? কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। বাবার আরো দু একটা প্লান শুনে মেঘালয় নিজের রুমে আসলো। এসেই কল করলো মিশুকে।
বাবার সমস্ত প্লানের কথা শুনে মিশু বললো, “এতকিছু কেন ব্যবস্থা করে ফেললো? এত তাড়াতাড়ি আমি বিয়ে করতে চাইনা।”
– “বিয়ে তো হয়েই গেছে। এমন ভাব করছো যেন তোমাকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছে আমার সাথে?”
– “ব্যাপার সেটা নয়। সংসার আর এত বড় একটা ওয়েডিং প্রোগ্রামের জন্য মেন্টাল প্রিপারেশন দরকার। হুট করেই হয়না।”
– “মিশু,প্রত্যেকটা মেয়ের স্বপ্ন থাকে এরকম ধুমধাম করে খুব আয়োজন করে বিয়ে হোক। বাবার মত শ্বশুর পাওয়াটা ভাগ্যের ব্যাপার। তুমি শ্বশুর শ্বাশুরি নয়,নতুন বাবা মা পেতে চলেছো।”
– “মেঘ,একটু বোঝার চেষ্টা করো প্লিজ।”
মেঘালয় বললো, “আমার ভাই হিমালয়কে হারিয়ে মা আমাকে বুকে আগলে রেখে বড় করেছে। তাদের কত স্বপ্ন আর আশা আমাকে নিয়ে। আমার পছন্দ ওরা মেনে নিয়েছে। তোমাকে ভালোবাসি কথাটা শুনে ওরা তোমার পরিচয় জানার ও প্রয়োজন মনে করেনি। মেনে নিয়েছে তোমায়। এখন ওদের করা প্লান গুলোকে আমি চুরমার করে দিতে পারিনা। তোমার আপত্তি থাকলে তুমি নিজে কথা বলো ওদের সাথে।”
মিশু একটু থেমে বললো, “আমিই বাবার সাথে কথা বলবো।”
– “কিহ! তুমি বাবার সাথে কথা বলবে তবুও বিয়ে করবে না?”
– “একটু সময় নিবো কিছুদিন। অন্তত দুইমাস।”
– “তারমানে আমাকে আরো দুইমাস তোমাকে ছাড়া থাকতে হবে? আমি পারছি না মিশু। আমার কষ্ট হয়।”
মিশুর জবাব পাওয়া গেলো না। কলটা হুট করেই হোল্ড হয়ে গেলো। মেঘালয় তিন মিনিট ফোন কানে ধরে রইলো, কল হোল্ড। ও রাগে ফোনটা গায়ের জোরে ছুড়ে মারলো। ফোনটা দেয়ালে লেগে ব্যাটারি খুলে বিছানার উপর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো। মেঘালয় মেঝেতে বসে রাগে নিজের মাথার চুল নিজে ছিড়তে লাগলো। আজকে দিনে মিশুকে কাছে পাওয়ার পর ওভাবে সরিয়ে দিয়েছে সেই আঘাতটা এখন আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। মেঘালয় ও তো মানুষ, কত সহ্য হয়?
ও সায়ানকে কল দিয়ে বললো, “দোস্ত কই তুই? খাওয়ার মত কিছু আছে?”
– “মানে? কি খাবি?”
– “মাল খাবো মাল। মেজাজ খুব গরম, কিছু আছে?”
– “এত রেগে আছিস কেন? মিশুর সাথে কিছু হয়েছে?”
মেঘালয়ের বুকে সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ার মতন প্রশ্নটা এসে লাগলো। কিভাবে এর উত্তর দিবে ও? কতটা দহনে দগ্ধ হচ্ছে সে শুধু মেঘালয়ের ভেতর টাই জানে। বাবা মায়ের করা প্লানগুলোকে কিভাবে ধুলিসাৎ করবে ভেবে আরো খারাপ লাগছে। দুপুরে মিশুর কাছ থেকে তাচ্ছিল্য হওয়ার পর মেজাজ চরম খারাপ হয়ে আছে। মিশু কি ভেবেছে ওকে? ও কি বনের জন্তু? কিন্তু সায়ানকে কিছু বলতে পারলো না।
সায়ান বললো, “কি হইছে আমাকে বলবি না?”
– “বাসায় আংকেল আন্টি আছে?”
– “না। দুজনেই সিলেটে আছে। দুদিন থাকবে।”
– “আমি আসছি তোর বাসায়।”
মেঘালয় ওর বাবা মায়ের রুমে এসে বাবাকে বললো, “আব্বু, আমি সায়ানদের বাসায় যাচ্ছি। কখন আসবো বলতে পারছি না। আমার ফোন আছাড় দিয়েছি, দরকার হলে সায়ানের নাম্বারে কল দিও।”
বাবা মা অবাক হয়ে তাকালেন মেঘালয়ের দিকে। কি বলছে কিছুই বুঝতে পারছেন না ওনারা। মেঘালয়ের কি হলো হঠাৎ করে? এমন তো কখনো করেনা ও। ফোন আছাড় দেয়ার মত বাজে অভ্যাস ওর কখনোই ছিলোনা। ওনারাও চিন্তায় পড়ে গেলেন।
মেঘালয় বললো, “আমি একটু একা থাকতে চাইছি দুটো দিন। মিশু ফোন দিলে কি বলে শুনিও। আর মিশুকেই জিজ্ঞেস করো ও এখন ই বিয়ের জন্য প্রস্তুত কিনা?”
বাবা কিছু একটা বলতে যাবেন কিন্তু তার আগেই মেঘালয় এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললো, “টেনশন করোনা আমার জন্য। শুধু দোয়া করো একটু। আমার মনের উপর দিয়ে খুব ঝড় বয়ে যাচ্ছে।”
আর কিছুই বললো না। সোজা বেড়িয়ে এসে গাড়ি নিয়ে সায়ানের বাসায় চলে এলো।
সায়ানকে সব কথা খুলে বলে অনেকটা হালকা লাগছে মেঘালয়ের। সায়ান নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। চেয়ে আছে মেঝের দিকে। ওর বিশ্বাস ছিলো দুনিয়া উলটে গেলেও মিশু কখনো বদলাবে না। সেই মিশুই বদলে গেছে ব্যাপারটা কিছুতেই ও মেনে নিতে পারছে না। ভেতরে দহন শুরু হয়ে গেলো ওর ও। এটা কিভাবে সম্ভব!
মেঘালয় মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। সায়ান বললো, “নিশ্চয় ভালোমতো ঘুমাস না। আজকে আমার সাথে ঘুমা তো। আমাকে একটু ভাবতে দে। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ মাইন্ডে একটা আলোচনা করা যাবে।”
মেঘালয় কিছু বললো না। ওর মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। গত একটা মাস ধরে একটু একটু করে মিশুর পরিবর্তন শুরু হয়েছে। প্রথমে বুঝতে পারেনি ও। বুঝতে পারার পর অনেকবার করে মিশুকে বলেছে তুমি আর আগের মত নেই। মিশু হেসেই উড়িয়ে দিয়েছে। আর এখন বললে অস্বীকার করছে কথাটা। কি করতে পারে ও এখন? চিন্তায় ঘুম আসবে না। তাই বেশ কয়েকটা স্লিপিং পিল খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। মাথাটাও একটু বিরতি চাইছিলো। শোয়ার পরপরই ঘুম এসে গেলো।
মেঘালয়ের ঘুম ভাংলো পরেরদিন দুপুর দুটার পর। সায়ান জানালো ওর আম্মু একবার ফোন দিয়ে খোজ নিয়েছে। মেঘালয় আশা করেছিলো মিশু একবার ফোন দেবে। কিন্তু মিশুর ফোন না পেয়ে একটু মন খারাপ ই হলো ওর। সায়ান খাবার নিয়ে এসে বলল, “আগে খা তারপর কথা বলি।”
মেঘালয় সায়ানের অনুরোধে একটু খাবার খেলো। তারপর দুই বন্ধু মিলে আলাপ করতে লাগলো কিভাবে মিশুকে সবকিছু বুঝিয়ে বলা যায়। সায়ান বললো, “যেভাবে পারিস ওকে একবার ট্যুরে নিয়ে যেতে হবে। প্রয়োজনে ঘুম পারিয়ে হলেও ওকে নিয়ে যেতে হবে। সিস্টেমে একবার ট্যুরে নিয়ে গেলে দেখবি একান্ত তোকে পেয়ে সব ভূলে গেছে।”
আইডিয়াটা বেশ পছন্দ হলো মেঘালয়ের। মিশুকে যেভাবে পারে ট্যুরে নিয়ে যেতে হবে। দরকার হলে মিথ্যে বলে নিয়ে যেতে হবে। কারণ প্রকৃতির কাছে গেলে ও একদম বদলে যায়। সেই বাচ্চা স্বভাবটা চলে আসে ওর মাঝে। এখন ওকে নিয়ে কোথাও একাকী ভাবে ঘুরতে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। একান্তভাবে পেলে সবকিছু বুঝিয়ে বলা সম্ভব। তারপর বিয়েতেও রাজি করানো যাবে।
কোথায় যাওয়া যায় এসব নিয়েও প্লান করে ফেললো। এখন কিভাবে মিশুকে ট্যুরে নিয়ে যাবে সেটা ভাব্বার বিষয়। এটা নিয়েই চিন্তা করতে লাগলো দুই বন্ধু মিলে। মেঘালয়ের ফোন তো বাসায় পড়ে আছে, মিশু কি একবার ফোনও দেয়নি? খুব জানতে ইচ্ছে করছে। তবুও মনটাকে শান্ত করে বসে রইলো ও।
সারাদিন কোথাও বের হলোনা। রাতে বের হয়ে পূর্ব, আরাফ ও সায়ানের সাথে রেস্টুরেন্টে গিয়ে একটু আড্ডা দিলো। কাজের চাপে অনেক দিন বন্ধুদেরকে সময় দিতে পারেনি। অনেকদিন পর সবার সাথে কথা বলে বেশ ভালো হয়ে গেলো মনটা। কিন্তু সায়ান ছাড়া কাউকেই জানালো না মিশুর এই অদ্ভুত পরিবর্তনের কথা।
রাতে সায়ানের বাসাতেই ফিরলো। বাড়িতেও কল দিলোনা। সায়ানকে জানিয়ে রাখলো মা ফোন দিলে যেন কথা বলে রেখে দেয়। ও একটু একা থাকতে চায়। রুমে চুপচাপ শুয়ে শুয়ে মনে করছে সেই প্রথম দিনের কথাগুলো। রাতারগুলে গিয়ে পাগলিটা চাটনি বিক্রি করা শুরু করে দিয়েছিলো। কত সুন্দর ছিলো মিশু পাগলীটা। এখনকার মিশুটাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না মেঘালয়। বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যেতে চাইছে।
এমন সময় সায়ান এসে বললো, “মেঘ, Rj প্রয়াসের মান্থলি ইনকাম কত হয় রে?”
মেঘ একটু ভেবে বললো, “ও তো অনেক রকমের কাজ করে। এই দুই লাখের মত আসে।”
সায়ান হেসে বললো, “বাহ! আর তোর মাসে কত আসে?”
– “আমি তো সেভাবে হিসেব করিনি। সবকিছু শুধু দেখাশোনা করি। যখন যা লাগে বের করে নেই। ইনকামের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবিনি কখনো।”
সায়ান এসে হাসতে হাসতে বললো, “এটাই স্বাভাবিক না? প্রয়াসের অনেক নাম যশ। হ্যান্ডসাম, সেলিব্রেটি, ফিল্ম টিল্ম করে। আরো কত কি!”
– “মানে? হঠাৎ ওর কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন?”
সায়ান ওর ফোনটা এগিয়ে দিলো মেঘালয়ের দিকে। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকানো মাত্রই মেঘালয় দেখতে পেলো প্রয়াসের আইডি থেকে ছবি আপলোড করা হয়েছে। সেই ছবিতে মিশু ওকে কেক খাইয়ে দিচ্ছে আর আশেপাশে অনেক লোকজন হাত তালি দিচ্ছে। ক্যাপশনে লিখেছে, “এই পুতুল বালিকাকে ছাড়া আমার বার্থডে একদম অসম্পূর্ণ থেকে যেতো।”
মেঘালয়ের মাথায় রক্ত উঠে গেলো যেন। ও সায়ানের ফোনটাই আছাড় মারতে যাচ্ছিলো। সায়ান ওকে থামালো। মেঘালয় কিছুতেই আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। বিছানার উপর একটা পাওয়ার ব্যাংক ছিলো সেটা নিয়েই মেঝেতে ছুড়ে মারলো।
সায়ান মেঘালয়কে ধরে বলল, “কি পাগলামি করছিস?”
মেঘালয় ডুকরে কেঁদে উঠলো এবার। সায়ানকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমি আর সহ্য করতে পারছি না রে। আর পারছি না। একটা মাস ধরে আমাকে এভোয়েড করে যাচ্ছে মিশু। আমি সহ্য করতে করতে আর নিতে পারছি না। এতদিন তবুও নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছি। কিন্তু এটা দেখার পর আর পারছি না।”
সায়ান বললো, “কষ্ট পাস না। হতে পারে ওদের মাঝে কোনো রিলেশন নেই। মিশু হয়ত জাস্ট ফ্রেন্ডলি মেশে। যেহেতু একসাথে কাজ করে,একটা ভালো বন্ডিং ক্রিয়েট হতেই পারে। তুই মন খারাপ করিস না। ও তো তোর বউ।”
মেঘালয় চোখ মুছে বললো, “আমার এতটুকু বিশ্বাস আছে যে মিশু আর কারো সাথে এফেয়ারে জড়াবে না। কিন্তু আমি যে ওকে কোনো ছেলের সাথে দেখলে সহ্য করতে পারিনা। আমার মাথা খারাপ হয়ে যায়। এটা কি মিশু জানেনা? তবুও কেন প্রয়াসের সাথে মিশতে যাবে ও?”
সায়ান কিছু বলার মত ভাষা খুঁজে পেলোনা। মেঘালয়কে সান্ত্বনা দিয়ে বললো, “টেনশন করিস না। হয়ত এমনিতেই দাওয়াতে গেছে,প্রয়াসই হয়ত ওকে পছন্দ করে। এটা নিয়ে মন খারাপ করিস না।”
মেঘালয় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, “মানলাম তোর কথাই ঠিক। কিন্তু অন্য কারো সাথে আমি ওকে মানতে পারিনা একদম ই। তুই কি জানিস আমাদের বিয়ের প্রথম রাতেই ওকে আমি থাপ্পড় মেরেছিলাম? ও তোদের সাথে ডান্স করেছিলো বলে। তোরা আমার সবচেয়ে আপনজন, তবুও আমি মেনে নিতে পারিনি। বাসর রাতে ঘরে ঢুকেই ও আমার থাপ্পড় খেয়েছে।”
সায়ান অবাক হয়ে তাকালো মেঘালয়ের দিকে।
মেঘালয় একটু থেমে আবারো বললো, “সায়ান রাগ করিস না। আমার প্রোগ্রামের দিন তোকে ওর হাত ধরে বসে থাকতে দেখে আমি সহ্য করতে পারিনি। অনেক কষ্টে গান গেয়েছিলাম। ওকে নিয়ে বাইরে আসার সময় তুই ওর কাঁধে হাত রেখেছিলি এটা দেখে আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। আমি কি করেছি জানিস? বাইরে বের হয়ে পাগলের মত বিহ্যাভ করছিলাম মিশুর সাথে। একবার বলছিলাম মেডিকেলে যাবো, একবার রিক্সা নিয়ে শিল্পকলা। আমার মেজো খালামণির সাথে চরম খারাপ আচরণ করেছিলাম সেদিন। বাসায় গিয়ে মিশুকে গলা টিপে মেরে ফেলতে চাইছিলাম শুধুমাত্র তোর সাথে ওভাবে দেখে। ওর জিভ বেড়িয়ে এসেছিলো এত জোরে টিপে ধরেছিলাম। ভাবতে পারিস?”
সায়ান অবাক হয়ে বললো, “মেঘ! তুই ওকে কতটা ভালোবাসিস আমাদের কারো অজানা নয়। ও ছোট মানুষ, হুট করেই নতুন পরিবেশ পেয়েছে তাই এরকম করছে। তুই প্লিজ মন খারাপ করিস না।”
– “আমি মরে যাবো রে ওকে ছাড়া। ও ছাড়া আমার দুনিয়াটা অন্ধকার।”
– “কিন্তু এখন ওকে এই ব্যাপার নিয়ে সিন ক্রিয়েট করে কোনো লাভ হবেনা। বরং ও আরো রেগে যাবে। যে বদলে যায়,তার মধ্যে কখনো এসব ন্যায় নীতি বোধ কাজ করেনা।”
মেঘালয় একটু ভেবে বলল, “আমি ওকে কিভাবে বুঝাবো? কি বললে বুঝবে ও?”
সায়ান কিছুক্ষণ গালে হাত দিয়ে বসে চিন্তা করলো। তারপর বললো, “ওকে বুঝাতে গেলেও ও ক্ষেপে যাবে। তখন উলটা তোর উপর রিয়েক্ট দেখাবে। বলতেও পারে আমি সেপারেশন চাই।”
– “কিহ!”
মেঘালয় দুহাতে মাথার চুল টেনে ধরে কান্না করে ফেললো। বললো, “আমার জগতের পুরোটাই ওকে দিয়ে দিয়েছি। সবখানে শুধু মিশু রাজত্ব করে। ওকে ছাড়া আমি থাকবো কিভাবে? আমাকে খুন করে ফেললেও এতটা কষ্ট হবেনা যতটা ওকে ছেড়ে দিতে হবে। আমি কি করবো এখন? কিছুই মাথায় আসছে না।”
সায়ান মেঘালয়কে জড়িয়ে ধরে রইলো কিছুক্ষণ। প্রখর আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মেঘালয় আজ নিতান্তই নিঃস্ব হয়ে গেছে। বড্ড অসহায় দেখাচ্ছে ওকে। এই মেঘালয় একজন সত্যিকার প্রেমিক,একজন সত্যিকার ভালোবাসার মানুষ। যে তার ভালোবাসা ছাড়া অসহায়। কিভাবে কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। সায়ান নিজে একবার কথা বলবে কি মিশুর সাথে?
মেঘালয় বললো, “আমার মাথা কাজ করছে না। কিছু খেতে হবে। ড্রিংকস করবো।”
– “পাগলামো করিস না তো। ভাব আর একটা উপায় বের কর। সবকিছুর আগে জানতে হবে মিশু প্রয়াসের সাথে কোনো রিলেশনশিপে গেছে কিনা।”
– “প্লিজ এই কথা বলিস না। প্রয়াসকে খুন করে ফেলবো আমি।”
– “শান্ত হ দোস্ত।”
মেঘালয় কে অনেক সান্ত্বনা দিচ্ছে সায়ান। তবুও মেঘালয় কিছু বুঝতে চাইছে না। ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। মিশুকে ছাড়া কিচ্ছু ভাবতে পারছে না ও।
মেঘালয় বললো, “আম্মু আব্বুকে এটা কিছুতেই বলা যাবেনা। ওরা ওদিকে বিয়ের প্লান করছে। আমি বলেছিলাম দশ দিনের মধ্যে এরেঞ্জ করতে। সেজন্য মামা চাচাদেরকেও ফোনে জানিয়ে দিয়েছে। সবাই এসে যাবে দুদিনের মধ্যে। কি করি এখন বল? এখন যদি মিশু বলে দেয় আরো সময় চাই,তখন বাবা মা কষ্ট পাবেনা?”
– “তা তো পাবেই। এটা তো আর রিলেশন নয় যে ব্রেকাপ করবি।”
মেঘালয় বললো, “রিলেশনের ব্রেকাপ হয়, স্বামী স্ত্রীর ডিভোর্স হয়। কিন্তু ভালোবাসার কখনো ব্রেকাপ হয়না রে। এটা আজীবন থাকে। আমি ওকে ভালোবাসি, প্রচণ্ড ভালোবাসি।”
সায়ান নিশ্চুপ। এরকম পরিস্থিতি আসবে সেটা ভেবে ও আগেই ভয় পেয়েছিলো। তবে ও ভেবেছিলো মেঘালয় বদলে যাবে। মিশু বদলে যাবে এটা ওর কল্পনাতীত ছিলো। এখন মেয়েটার মনে কি চলছে বুঝে আসছে না ওর।
মেঘালয় হঠাৎ উঠে বাথরুমে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে এসে বললো, “আমি একটু বের হবো।”
-“কই যাবি?”
মেঘালয় কোনো উত্তর দিলো না। চুপচাপ বসে ভাবতে লাগলো। কি যেন ভাবছে গভীর মনোযোগ দিয়ে। সায়ান ওর দিকে বারবার তাকাচ্ছে কিন্তু কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। মেঘালয় উঠে দাঁড়িয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো, “আমি মিশুর কাছে যাচ্ছি।”
সায়ান চমকে উঠলো- “এত রাতে?”
– “হুম।এবার আমি কি করি তাই দ্যাখ। আমার অবহেলা সহ্য হচ্ছেনা।”
সায়ান তাকিয়ে রইলো মেঘালয়ের দিকে। মেঘালয়ের চোখেমুখে যেন আগুন ঝরছে। ও বাসা থেকে বেড়িয়ে গাড়ি নিয়ে দ্রুত মিশুর বাসার দিকে রওনা দিলো।
চলবে..