অনুভূতি
পর্ব -০৫
মিশু মনি
অনুভূতি ! পর্ব_১
অনুভূতি ! পর্ব_২
অনুভূতি ! পর্ব_৩
অনুভূতি ! পর্ব_ ৪
১৩.
বাসর ঘরে ফুলের উপর পা তুলে বসে আছে দুপুর।
আজ এই বিছানায় রোদের বসে থাকার কথা ছিলো। মাত্র কয়েক মুহুর্তের ব্যবধানে এখন এখানে দুপুর বসে আছে। রোদ কোথায় কি অবস্থায় আছে কে জানে, কিন্তু দুপুর ও নিখিল দুজনের ভিতরে একটু আগেই সর্বোচ্চ মাত্রার ঝড় বয়ে গেছে। যার রেশটা এখনো রয়ে গেছে। আনমনা হয়ে বসে বসে এই আকস্মিক ঝড়ের কথা ভাবছে দুপুর। কি থেকে কি হয়ে গেলো কিছুই বোঝা গেলো না।
দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করলো অরণ্য। ওকে বেশ উজ্জ্বল আর হাসিখুশি দেখাচ্ছে যেন বিয়েটা দুপুরের সাথেই হবার কথা ছিলো। এগিয়ে এসে দুপুরকে বললো, “ওভাবে চেয়ে আছো যে?”
দুপুর চোখ নামিয়ে নিলো। অরণ্য মাথা থেকে পাগড়ি খুলে রেখে আস্তে আস্তে বিছানার কাছে এসে দুপুরের পাশে বসলো। দুপুর খুব অপ্রস্তুত বোধ করছে। আজকে দিনেও অরণ্য কে দুলাভাই বলে ডেকেছিলো ও। এখন তারই সাথে বাসর হচ্ছে! আর নিখিল? ডুকরে কান্না পেয়ে গেলো দুপুরের।
অরণ্য জিজ্ঞেস করলো, “কি ভাবছো দুপুর? রোদের জন্য মন কেমন করছে?”
দুপুর দুদিকে মাথা নাড়িয়ে না বললো। অরণ্য বললো, “যা হবার তা তো হয়েই গেছে। সে নিজের লাইফ নিজেই বেছে নিয়েছে। আমাদের কারো কথা সে ভাবেনি। আমরা কেন তাকে ভেবে অযথা কষ্ট পাবো বলোতো? আমাদের এখন একটা নতুন লাইফ শুরু হতে যাচ্ছে। আমাদের উচিৎ নিজেদের জীবনটাকে গুছিয়ে নেয়া।”
দুপুর মাথা নিচু করে রইলো। যদি ওর জীবনে নিখিল বলতে কেউ না থাকতো, তাহলে হয়ত এটা মেনে নিয়ে খুব সুখী হতে পারতো। অরণ্য নিঃসন্দেহে একজন ভালো ছেলে, স্বামী হিসেবেও অনেক ভালো। এরকম একজনের সাথে অনায়াসে সুখী হওয়া যায়। কিন্তু দুপুরের সবটুকু ভালোবাসা যে নিখিলের জন্যই ছিলো। এখন নিখিলকে ভূলে গিয়ে আবার নতুন করে অরণ্যকে ভালোবাসতে অনেক কষ্ট হবে। সবকিছু মেনে নেয়া সহজ হলেও, সুখী হওয়া সহজ নয়। কিছুতেই সুখী হতে পারবে না দুপুর।
অরণ্য আস্তে করে ঘোমটা টা সরিয়ে বেশ কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলো দুপুরের দিকে। দুপুর কে আজ একটু বেশিই অপূর্ব লাগছে! ও যে এতটা সুন্দর সেটা আগে বোঝা যায়নি। আলতো করে দুপুরের ডান গালটা হাত দিয়ে স্পর্শ করলো অরণ্য। দুপুর চোখ বন্ধ করে ফেললো। ওর এখন খুব বেশি কষ্ট হচ্ছে। নিখিল নিশ্চয়ই এখন কেঁদে পাগল হয়ে যাচ্ছে। নিখিলকে ওরকম দুঃখ দিয়ে কিভাবে ভালো থাকবে দুপুর? নিখিল তো আসতে চেয়েছিলো দুপুরের বাবার কাছে, কিন্তু দুপুর ই নিষেধ করে দিয়েছে। কেন করলো এটা? দুপুরের নিজের প্রতি ভীষণ রাগ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে এই বাসর ঘরে আগুন লাগিয়ে দিতে। কিন্তু কিইবা করার আছে। নিজের ইচ্ছায় সে এ বিয়েতে মত দিয়েছে। একবার না বললে বাবা কখনোই বিয়ে দিতো না। কিন্তু বাবার সম্মানের কথা ভেবে এটা করতে হয়েছে ওকে। কি করবে এখন ও?
দুপুরের চোখ বেয়ে টপ করে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো।
অরণ্য বললো, “দুপুর… কাঁদছো কেন? বাসার কথা মনে করে?”
দুপুর কিছু না বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। অরণ্য বললো, “তোমার কি টায়ার্ড লাগছে? ঘুমাতে চাও?”
প্রশ্নটা শুনে অনেক অবাক হয়ে গেলো দুপুর। মাথা নেড়ে হ্যা জানালো।
অরণ্য বললো, “আচ্ছা তুমি তাহলে ঘুমাও।”
চমকে ওর দিকে তাকালো দুপুর। বাসর ঘরে ছেলেরা সাধারণত খুব চেষ্টা করে বউকে ঘুমাতে না দেয়ার জন্য। আর অরণ্য ঘুমাতে বলছে! সত্যিই একবার মুগ্ধ হতেই হলো। দুপুর কোনো কথা না বলে আস্তে করে শুয়ে পড়লো। অরণ্য এসে বরের সাজ পোশাক বদলে টিশার্ট পড়ে ঘুমাতে গেলো।
দুপুরের কিছুতেই ঘুম আসছে না।একবার নিখিলের কণ্ঠটা না শুনলে ওর ঘুম আসবে না। কিন্তু এখন কিভাবে ওকে ফোন দেবে ও? সেটা যে আর হয়না। ওই অধিকার টা আর নেই।
অনেক চেষ্টা করেও আর পারলো না দুপুর। একবার নিখিলের কণ্ঠটা ওকে শুনতে ই হবে। বালিশের পাশ থেকে মোবাইল টা নিয়ে নিখিলকে কল দিলো। প্রথম বার রিং হতেই রিসিভ করলো নিখিল। কিন্তু রিসিভ করে কয়েকবার হ্যালো হ্যালো বললো। কিন্তু দুপুর চুপ করে ওর ভয়েস টা শুনে যেতে লাগলো। ভেতরে ভেতরে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। তবুও শান্ত হয়ে শুনতে লাগলো ওর কণ্ঠ।
নিখিল বারবার প্রশ্ন করে যাচ্ছে। ও ভেবেছে দুপুরের হয়ত বিয়েটা হয়নি। একটু আশার আলো দেখতে যাচ্ছিলো। এভাবে ওকে কষ্ট দেয়া যায়না। দুপুর আস্তে করে উঠে বাথরুমে চলে এলো। এসে টেক্সট পাঠালো নিখিলের নাম্বারে, “ami bashor ghore shuye achi Nikhil. tomar kontho ta shunte icche korchilo tai phone dilam. amk maf kore dio.”
মেসেজ টা দেখে যতটা কষ্ট পাওয়া সম্ভব তারচেয়ে বেশি পেলো নিখিল। সে বাসর ঘরে শুয়ে আছে অন্য একটা ছেলের সাথে আর সেটা মেসেজ করে পাঠিয়েছে? এরচেয়ে কষ্টের আর কি হতে পারে?
দুপুর মুখ ধুয়ে আবারো রুমে চলে আসলো। মনে মনে থ্যাংকস জানাচ্ছে অরণ্যকে। সে ঘুমাতে না দিলে আরো বেশি কষ্ট হতো দুপুরের। ও বিছানায় শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে শুধু কেঁদেই যেতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেললো একদম।
১৪.
মেঘালয় জিজ্ঞেস করলো, “তোমার এখন কি ইচ্ছে করছে?”
– “আপনার গান শুনতে।” নিঃসংকোচে উত্তর দিলো মিশু।
মেঘালয় হেসে বললো, “এই ট্রেনে গান শুনবা? লোকজন কি বলবে?”
– “ফিসফিস করে শোনান। খুব আস্তে আস্তে।”
– “এসএমএস করে পাঠাই তাহলে।”
বলেই হাসলো। মিশুও হাসতে যাচ্ছিলো কিন্তু হাসতে পারলো না। তার আগেই মেঘালয়ের আচরণে অবাক হয়ে গেলো। মেঘালয় একদম মিশুর কানের কাছে এসে গাইতে আরম্ভ করলো,
“এ জীবনে যারে চেয়েছি…
আজ আমি তারে পেয়েছি…
তুমি আমার সেই তুমি আমার…
মিশুর কানের উপর মেঘালয়ের গরম নিঃশ্বাস পড়ছে। সেইসাথে ওর মায়াবী কণ্ঠে এই গান শুনে মিশুর শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো।
– “তুমি ছিলেনা, ছিলোনা আশা…
তোমায় পেয়ে আশা বেঁধেছে বাসা….”
মিশু একটু মাথাটা ঘোরাতেই মেঘালয়ের সাথে চোখাচোখি হলো। একদম কাছ থেকে দেখলো মেঘালয়ের চোখ দুটো। চোখাচোখি হতেই কেমন যেন লাগলো বুঝে উঠতে পারলো না ও।
মেঘালয় হেসে হেসে গান গেয়ে শুনাচ্ছে। গান থামাতেই মিশু বললো, “আরো শুনবো।”
মেঘালয় আবারো আরেকটা গান শুনাতে আরম্ভ করলো। শুনতে শুনতে ঘুম এসে যাচ্ছিলো মিশুর। আস্তে করে সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজলো। মেঘালয় গান থামালো না। মিশু ওর গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লো। মাথাটা ঘুমে ঢলে পড়ে যাচ্ছিলো। মেঘালয় আস্তে করে ওর মাথাটা নিজের কাঁধের উপর নিয়ে নিলো। মেঘালয়ের কাঁধে মাথা রেখে আরামে ঘুম দিলো মিশু।
বারবার মিশুর ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকাচ্ছে মেঘালয়। বড্ড মায়াবী লাগছে দেখতে। আসলে সেই প্রথম দিনেই তো মিশু এক নামহীন মায়ায় জড়িয়ে ফেলেছে ওকে। সেই মায়ার কোনো নাম হয়ত নেই। যে মায়ার টানে প্রতিদিন বারবার ছুটে যেতো ওর দোকানে। শুধুমাত্র একটা বার দেখার জন্য,কথা বলার জন্য। আর মিশুর জন্য কিছু করার ইচ্ছেটাও খুব পেয়ে বসেছিলো মেঘালয় কে। আস্তে আস্তে ওর প্রতি দূর্বলতা তৈরী হচ্ছে। কিন্তু সেটা বুঝতে পারছে না মেঘালয়।
জানালা দিয়ে মিষ্টি বাতাস আসছে। কোথায় যাচ্ছে কেউই জানেনা। খুলনার টিকেট কাটা হয়েছে। এখন যেখানে খুশি নেমে যাওয়া যায়। নয়ত খুলনা অব্দিও যাওয়া যেতে পারে। মেঘালয় আবারো তাকালো মিশুর ঘুমন্ত মুখের দিকে।
১৫.
মিশু মেঘালয়ের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। ট্রেন চলেছে ঝিকঝিক শব্দে। হাওয়ায় চুল উড়ছে মিশুর। মাঝেমাঝে চুল উড়ে এসে মেঘালয়ের মুখের উপর পড়ছে। মনটা কেমন কেমন যেন করছে মেঘালয়ের। জীবনে প্রথমবার কেউ এভাবে ওর কাঁধে মাথা রেখেছে। মিশুই প্রথম সেদিন রাতে ওর পিঠে মাথা রেখেছিল, আজ কাঁধে। সম্পূর্ণ অচেনা একজন মেয়ে ধীরেধীরে কিভাবে যেন বড্ড কাছে এসে যাচ্ছে, আপন হয়ে যাচ্ছে। অন্যরকম কোনো ব্যাপার যে ঘটছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হলো না মেঘালয়ের। সামনে থেকে একজন যাত্রী ছবি তুলে নিলো ওদের দুজনের। মেঘালয়ের অন্যদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ ই নেই।
একবার আড়চোখে মিশুর ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে বুকটা কেমন যেন করে উঠলো ওর। চোখ বুজে ভাবতে লাগলো, কি অদ্ভুত ব্যাপার! এরকম কখনো হয়না ওর সাথে। ইদানীং কিসব কান্ড যে ঘটে বুঝতে পারেনা ও। রাতে ঘুমালেই স্বপ্নে একটা মেয়েকে দেখতে পায়। মেয়েটা খোলাচুলে হেঁটে যায় সমুদ্রের তীর ঘেষে। বিশাল ঢেউ এসে ওর উপর দিয়ে আছড়ে পড়ে তীরে। ভয় হয় মেঘালয়ের। এই বুঝি মেয়েটাকে সমুদ্র তার ভিতরে টেনে নিয়েছে। কিন্তু ঢেউ নেমে যেতেই আবারো দেখা যায় মেয়েটি দিব্যি হেঁটে যাচ্ছে। ওর মুখ স্পষ্ট বুঝতে পারেনা মেঘালয়। শুধু চুলগুলো দেখতে পারে, কত চেনা সেই চুল আর চুলের গন্ধ!
চমকে উঠলো মেঘালয়। স্বপ্নে তো চুলের গন্ধ বুঝতে পারার কথা নয়। কিন্তু কারো চুলের গন্ধ যে নাকে লাগছে! চোখ মেলে দেখলো মিশুর এক গোছা চুল উড়ে এসে মুখের উপর পড়েছে। সেই গন্ধই নাকে লাগছিলো। মিশু যে কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে স্বপ্নের কথা ভাবতে গিয়ে সেটা ভূলেই গিয়েছিলো ও। আরেকবার মিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মেঘালয়। মিশু গভীর ঘুমে মগ্ন যেন কত রাত ভালোমত ঘুমায় না মেয়েটা! বড্ড মায়া লাগছে ওর জন্য।
একজন যাত্রী এসে মেঘালয় ও মিশুর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললো, “আরে মেঘ না?”
মেঘালয় ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বললো, “হিরণ ভাই? আমাদের ভার্সিটির বড় ভাই ছিলেন?”
– “হ্যা হ্যা।”
খুশিতে মাথা ঝাঁকাচ্ছে হিরণ। মেঘালয় হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করতে যেতেই মিশুর মাথাটা ওর বুকে ঢলে পড়ে যেতে লাগলো। হাত দিয়ে মিশুকে ধরে ফেললো ও।
হিরণ হেসে বললো, “ইটস ওকে। তোমার গার্ল ফ্রেন্ড?”
প্রশ্নটা করেই হিরণ হাসলো। মেঘলয় কি বলবে বুঝতে না পেরে মিশুর দিকে তাকালো। সত্যিই কি বলা উচিৎ বুঝতে পারছে না। ওর বোনকে তো হিরণ চেনে। কাজিন বললে উলটা পালটা কিছু ভেবে বসবে। কিছু বলার আগেই হিরণ বললো,, “আমি ওই যে ওই সিটে বসেছি।”
মিশুর ঘুম ভেঙে গেলো। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলো একজন লোক সামনে দাঁড়িয়ে আছে, মেঘালয়ের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। আর তারই সামনে ওর কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিলো ও? ভাবতেই লজ্জায় লাল হয়ে গেলো মিশু।
হিরণ মিশুকে বলল, “কি ভাবি,ঘুম হলো?”
মিশু আচমকা ভাবি শব্দটা শুনে ভড়কে গেলো। সে কি মিশুকে মেঘালয়ের বউ ভেবেছে নাকি? ওর মত বাচ্চা মেয়েটাকে বউ বউ লাগে? আজকালকার লোকজনের আইডিয়া দেখলে হাসি পায়।
মিশু মনেমনে এসব ভাবছে। এদিকে সে যে মেঘালয়ের কাঁধে মাথা রাখলে এটা ভাবাটাই স্বাভাবিক সেটা ওর মাথাতেও এলো না। বড্ড সরল একটা মেয়ে।
হিরণ গিয়ে তিনকাপ চা নিয়ে এসে দিলো। চায়ে চুমুক দিয়ে মিশু বললো, “আমার না খিদে পেয়েছে।”
হিরণ তাকালো মিশুর দিকে। বাচ্চা স্বভাবের মেয়ে কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে। মেঘালয় হাসি চেপে রেখে বললো, “আচ্ছা বসো, আমি খাবার নিয়ে আসছি।”
– “চা শেষ করে যান।”
– “কি খাবা বলো?”
মিশু একটু ভেবে বলল, “আপনি কি চলন্ত গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে খাবার আনতে যাবেন?”
মেঘালয় হেসে বলল, “গাড়ির ভিতরেই রেস্টুরেন্ট আছে। আমি অর্ডার দিয়ে আসি। ভাত খাবে? মুরগির মাংস দিয়ে?”
– “আমি হাসের গোশত দিয়ে ভাত খাবো। ঝাল ঝাল করে যেন রান্না করে।”
মেঘালয় এবার আর হাসি চেপে রাখতে পারলো না। মেয়েটা এখনো বোধহয় ঘুমের ঘোরেই আছে। ঘুম জড়ানো গলায় এভাবে কিছু বললে একদিকে ভালো লাগে, অন্যদিকে হাসি পায়। হিরণ ভাইও রীতিমত অবাক হয়ে চেয়ে আছেন।
মেঘালয় বলল, “আমি দেখছি পাওয়া যায় কিনা। না পাওয়া গেলে ঢাকায় গিয়ে হাস কিনে ঝাল ঝাল করে রান্না করে খাওয়াবো।”
বলেই উঠে দাঁড়ালো। চা শেষ করে কাপ নিয়ে হিরণের সাথে কোথায় যেন আড়াল হয়ে গেলো। মিশু উঠে গিয়ে রৌদ্রময়ীর পাশে বসলো। নতুন বউটাকে খুব মনমরা দেখাচ্ছে। একটু গল্প করা যাক, যদি বউটার মনটা ভালো হয়!
১৬.
আজ বৌভাত।
ঘুম থেকে উঠতে বড্ড দেরি হয়ে গেলো দুপুরের। উঠে আড়মোড়া ভেঙে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সাড়ে নয়টা বেজে গেছে। নতুন বউ সাধারণত এত বেলা অব্দি ঘুমায় না। বাসার লোকজন কি যে ভাবছে কে জানে!
তাড়াহুড়ো করে উঠে বিছানা থেকে নামতে গিয়ে হুরমুর করে পড়ে গেলো দুপুর। অরণ্য ঘরেই ছিলো। ব্যস্ত হয়ে ছুটে এসে দুপুরের পাশে বসে বলল, “আরে পড়ে গেলে কিভাবে? ব্যথা পেয়েছো?”
দুপুর মাথা দুপাশে নাড়িয়ে বলল, “না। আমি ঠিক আছি।”
আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো দুপুর। অরণ্য অবাক হয়ে খেয়াল করলো দুপুরের চোখ লাল হয়ে আছে, একদম ফুলে গেছে চোখ দুটো। রাত্রে সে কান্না করেছে বুঝতে অসুবিধা হলো না অরণ্য’র। কিন্তু কান্না করার মত কোনো কারণ কি ছিলো?
উৎসুক চোখে দুপুরের দিকে তাকিয়ে রইলো অরণ্য। দুপুর বাথরুমের দিকে চলে গেলো। অরণ্য বিছানার উপর বসে বসে ভাবতে লাগলো। মেয়েটাকে হুট করে বিয়ে দিয়ে দেয়ায় কষ্ট পেয়েছে বোধহয়। আগে যেভাবে কথা বলতো, বিয়ের পর আর সেভাবে বলতে পারছে না।
দুপুর গোসল করে এসে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো কোনো কল এসেছে কিনা। রোজ সকালে নিখিলের ফোনকলে ঘুম ভাঙত ওর। ছেলেটা বড্ড খেয়াল রাখতো দুপুরের। আজ সে কেমন আছে? খুব জানতে ইচ্ছে করছে দুপুরের।
অরণ্য বেশ কিছুক্ষণ ধরে চেয়ে আছে দুপুরের দিকে। দুপুর ঠিকমত চুল ও মুছতে পারেনা। চুল বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। চুলের পানিতে জামা ভিজে যাচ্ছে,মেঝেতেও টপটপ করছে পানি। অরণ্য তোয়ালে নিয়ে এগিয়ে এসে দুপুরের পিছনে দাঁড়িয়ে বললো, “একটু চুলও মুছতে পারোনা ঠিকমত? একটু নিজের খেয়াল রাখা কবে শিখবে বলোতো?”
চমকে উঠলো দুপুর। অরণ্য এমন ভাবে বলছে, ওর কথার সাথে কণ্ঠের আবেশ মিশে একদম অন্যরকম সুন্দর শোনাচ্ছে। যে কারো ভালো লাগতো শুনলে। দুপুর কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। চোখের পাপড়ি ও নড়ল না ওর। অরণ্য তোয়ালে দিয়ে ভালোভাবে চুল মুছিয়ে দিতে লাগলো দুপুরের। এরকম যত্ন পেয়ে আবেশে চোখ বুজে ফেললো দুপুর। অরণ্য খুব মনোযোগ সহকারে দুপুরের চুল মুছে দিচ্ছে। এই কাজটা করতে অরণ্য’র সে খুবই ভালো লাগছে সেটা ওর চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। মুখে প্রসন্ন হাসি।
চুল মুছে দেয়ার পর অরণ্য বললো, “একি হাল করেছো নিজের? মাত্র একদিনেই এই অবস্থা? শোনো, আমার রুমে থাকতে হলে এরকম মনমরা হয়ে থাকা যাবেনা। বুঝলে?”
দুপুর চুপ করে রইলো। মনমরা হয়ে থাকলে কি সে রুম থেকে বের করে দিবে? যদি দিতো তাহলে সারাক্ষণ মন খারাপ করে থাকতো ও। কিন্তু বের করে দেয়ার পথটা এতটা সহজ না। আর বের হওয়ার জন্য সে এ বাড়িতে আসেও নি। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো দুপুর।
অরণ্য বললো, “মুখে ক্রিম ব্যবহার করো তুমি?”
দুপুর এক পলক তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিয়ে মাথা ঝাঁকাল। অরণ্য আয়নার সামনে রাখা ক্রিমের দিকে তাকিয়ে বললো, “ফেয়ার এন্ড লাভলী মেনস ক্রিমে হবে তোমার?”
এরকম আজগুবি প্রশ্নের উত্তরে কেমন রিয়েকশন দেয়া দরকার বুঝতে পারলো না দুপুর। দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইলো। অরণ্য মুখ টিপে হেসে বললো, “ওহ সরি। তুমি উইমেন্স ভূলেই গিয়েছিলাম। দেখেছো তোমার বরটা কেমন আত্মভোলা? তার বউ মেন নাকি ওমেন সেটাই মনে রাখতে পারেনা আর বউয়ের কেয়ার কিভাবে নিবে বলোতো?”
নিতান্তই বাচ্চাদের মত করে নরম কণ্ঠে কথাগুলো বললো অরণ্য। দুপুরের ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসির আভাস ফুটে উঠলো। সেটুকু বুঝতে পেরে ভালো লাগলো অরণ্য’র। আসলে দুপুরকে একটু হাসানোর জন্যই এভাবে বলছে ও। আরেকটু চেষ্টা করতে হবে।
অরণ্য বললো, “এরকম খাম্বার মত দাঁড়িয়ে আছো যে? পা পুরনো হয়ে ভেঙে যাবে বাবা।”
দুপুর একবার তাকালো অরণ্য’র দিকে। চোখে প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে, “পা কিভাবে পুরনো হয় আবার?”
অরণ্য বললো, “কি ভাবছো? পা কিভাবে পুরনো হয় তাইতো? দেখো বিদ্যুতের খুটি পুরনো হয়ে গেলে ভেঙে যায়। যায়না?”
দুপুর এবার কথা না বলে পারলো না, “আমাকে আপনার বিদ্যুতের খুঁটি মনে হচ্ছে কোন দুঃখে?”
– “নাহ, তোমাকে বিদ্যুতের খাম্বা মনে হওয়ার কোনো কারণ ই নেই। তুমি মোটেও লম্বা নও,তুমি তো শর্ট।”
– “আমি শর্ট?”
– “আমার তুলনায় অনেক শর্ট। আমার পাশে তুমি দাঁড়ালে মনে হয় বিদ্যুতের খুটির পাশে বনমানুষ দাঁড়িয়ে।”
কথাটা শুনে ক্ষেপে গেলো দুপুর -“কিহ! এভাবে বলা হচ্ছে? আমাকে কোন এঙ্গেল থেকে খাটো মনেহয় আপনার শুনি?”
অরণ্য আপাদমস্তক তাকিয়ে বললো, “সবদিক থেকেই। যে পরিমাণ শর্ট তুমি, না জানি আমার বাচ্চাকাচ্চাদের তেলাপোকার বাচ্চা মনে হয় কিনা।”
এবারে আরো ক্ষেপে গেলো দুপুর। রেগে বললো, “আমাকে বিয়ে করতে কে বলেছে আপনাকে? কেন করলেন?”
– “একি! দুপুরবেলা ক্ষেপে গেছে দেখছি। আরে বাবা আমি তোমাকে একটু সহজ হওয়ার জন্য কথাগুলো বললাম। বুঝোনা তুমি?”
দুপুর মাথা নিচু করে ফেললো। সত্যিই তো! মাত্র দুটো কথা বলেই অনেকটা স্বাভাবিক লাগছিলো নিজেকে। মনটাও ভালো হতে শুরু করেছিলাও। মুহুর্তের জন্য নিখিলকে ভূলে গিয়েছিলো ও।
অরণ্য বললো, “তুমি কি কোনোকিছু নিয়ে আপসেট? দুপুর?”
দুপুর দুদিকে মাথা নাড়ালো।
– “বাবা মায়ের জন্য খারাপ লাগছে? নাকি বোনের জন্য?”
– “না।”
– “হঠাৎ বিয়ে দিয়ে দেয়ায় তুমি কষ্ট পেয়েছো?”
– “না।”
– “তাহলে?”
দুপুর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। কিভাবে বলবে ওকে যে ওর নিখিলের জন্য বুকটা হাহাকার করছে? রৌদ্রময়ী তো পালিয়ে গিয়ে বেঁচেছে, বাবা মা তো দুপুরের সাথে অরণ্য’র বিয়ে দিয়ে বেঁচেছে, অরণ্য ও একজনের পরিবর্তে আরেকজন কে পেয়ে বেঁচেছে, আর দুপুর? দুপুরের ভেতরে কি পরিমাণ ঝড় চলছে কে বুঝবে সেটা? কাউকে বলাও যায়না, সহ্য করাও যায়না। কি নিদারুণ যন্ত্রণা সে শুধু দুপুর ই জানে।
এমন সময় অরণ্য’র ছোট বোনের গলা শুনতে পাওয়া গেলো, “এই ভাইয়া, ভাবি তোরা উঠবি না? দশটা বাজে তো।”
অরণ্য উঠে দরজা খুলতে চলতে গেলো। নিরবে বসে রইলো দুপুর। আজ তাকে কেউ ভাবি বলে ডাকছে! অথচ গতকাল ই তো তার জীবন টা অন্যরকম ছিলো। মাত্র কয়েক মুহুর্তের ব্যবধানে কি থেকে কি হয়ে যায়! জীবন অদ্ভুত!
চলবে..