#বিবাহিত_ব্যাচেলর
#ইসরাত_জাহান_তানজিলা
#পর্ব_2
কাজী সাহেব রাহুল সাহেবের দিকে তাকিয়ে বিরক্তির সুরে বলল,
-‘এ মেয়ে তো কবুল বলছে না।’
রাহুল সাহেব একটু নড়চড়ে বসে বলল,
-‘কাজী সাহেব আপনি তো জানেন আমাদের বংশে একটা এতিহ্যবাহী প্রথা আছে। আমাদের কাছে কেউ মেয়ে বিয়ে দিতে চায় না।আমার চৌদ্দ পুরুষ এভাবে মেয়ে তুলে এনে জোর করে বিয়ে করেছে। এই যে দেখেন তূর্যের আম্মু কেও আমি কলেজ থেকে তুলে নিয়ে এসে বিয়ে করি।পূর্বপুরুষের কাছে শোনা, সবাই ই নাকি কবুল বলতে চায় নি। কবুল বলাতে আধাঘন্টা সময় লেগেছে কিন্তু এই মেয়ে এলরেডী পয়ত্রিশ মিনিট পার করে ফেলছে।’
কাজী সাহেব গভীর মনযোগ দিয়ে রাহুল সাহেবের কথা শুনছে। লোকটা কত সাবলীল ভাবে কথা গুলো বলছে।
এভাবে কবুল বলানোর জন্য বসে থাকতে থাকতে অসহ্য হয়ে গেছে তূর্য। রাহুল সাহেব কে উদ্দেশ্য করে বলল,
-‘আব্বা অয় এত সহজে কবুল বলবে না। যা করার তাই করতে হবে।’
রাহুল সাহেব জিদনির দিকে আড় চোখে তাকিয়ে তূর্য কে বলল,
-‘আর একটু অপেক্ষা কর না বাপ। এত তাড়াহুড়া করলে চলে। ছোট বেলা থেকেই তো আমরা দেখে আসছি জিদনি খুব জেদী,একঘেয়ি। আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে যদি ও কবুল না বলে তারপর যা হবার হবে।’
চমকে জিদনি বলে,
-‘কি করবেন কি আপনারা? মেরে ফেলবেন আমায়? আচ্ছা মারুন।’
রাহুল সাহেব বলল,
-‘তুমি আমার বাড়ির হবু পুত্রবধূ তোমায় মারব এটা কি হয় বলো? যা করার তাই করব।’
.
চারদিকে লোক পাঠিয়ে জিদনি কে খুঁজছে ওর বাবা-মা । বর পক্ষ কে অনেক অনুরোধ করে বসিয়ে রেখেছে। পারা-প্রতিবেশী এক এক জন এক এক রকম কথা বলছে। জিদনির মা কাঁদতে কাঁদতে জিদনির বাবা উদ্দেশ্য বলল,
-‘তুমি একবার চেয়ারম্যান বাড়ি খোঁজ নিয়ে দেখো। আমার তো মনে হচ্ছে উনারা জিদনি কে তুলে নিয়ে গেছে।’
-‘নিয়ে গেলেও কি ওরা জিদনি কে বাসায় রেখেছে? আর আমার মনে হয় অন্য কেউ। তূর্য তো কয়েক দিন আগে দেশের বাইরে গেলো।’
কান্নায় ভেঙে পড়ছে জিদনির মা। জিদনির বাবা চশমার ফাঁক দিয়ে চোখ মুছে বলল,
-‘কেঁদো না তুমি। টেনশন করো না হার্টের প্রোবলেম টা বাড়বে তাহলে।’
-‘আমার একটাই মেয়ে আমি কি করবো? আমার মেয়ে টা পাচ্ছি না। কার এমন শত্রুতা আমাদের সাথে?’
জিদনির বাবা কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল,
-‘এমনও তো হতে পারে তোমার মেয়ের সাথে কারো সম্পর্ক ছিলো। তাঁর সাথে পালিয়ে গেছে।’
-‘কি আবল তাবল বকছো?’
-‘কে এমন হয় না? হতে পারে না? আমি কাকে দোষারপ করব বলো?’
চারদিকে যত লোক পাঠিয়েছে কেউই খুঁজে পায় নি জিদনি কে । হতাশ হয়ে বসে রইল জিদনির বাবা। আত্মীয়-স্বজনের মান-সম্মান সব শেষ হয়ে গেলো।
-‘আমি নিজে যাবো জিদনি কে খুঁজতে।’
জিদনির মা বলল,
-‘বাসা ভরা মেহমান তাঁর ভেতর তুমি কোথায় যাবা?’
-‘আচ্ছা চেয়ারম্যান দের তো দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। উনারা কি এসেছে?’
-‘চেয়ারম্যান কে তো তুমি কম অপমান করো নি। তোমার কি মনে হয় উনি আসবে? আর তূর্য জিদনি কে শুধু ভালোবাসত কখনো রাস্তা-ঘাটে বিরক্ত করে নি ।’
জিদনির বাবা বিরক্ত হয়ে বলল,
-‘কি বলতে চাও তুমি? ওরকম একটা লাফাঙ্গা ছেলের কাছে আমার মেয়ে বিয়ে দিবো?’
.
বরের বাবা এসে জিদনির বাবা কে বলল,
-‘আর কতক্ষন বসে থাকবো?আপনাদের প্রোবলেম কি বলুন? এরকম শুরু করেছেন কেন? এতক্ষন এভাবে বসে থাকা বেমানান ব্যাপার।’
বরপক্ষ আসার পর কিছু খেতেও দেয় নি। খালি মুখে এতক্ষন বসিয়ে রেখেছে। এরকম দুঃচিন্তার মধ্যে এতসব কারই বা খেয়াল থাকে। জিদনির বাবা বিনয়ের শুরু বলল,
-‘আর একটু ওয়েট করেন প্লীজ।’
-‘আপনাদের প্রোবলেম কি বলেন তো?’
-‘না তেমন কোন প্রোবলেম নেই। আপনারা আর দশ মিনিট ওয়েট করুন।’
-‘দেখুন এভাবে ওয়েট করা বেমানান। আপনাদের প্রোবলেম কি বলেন?’
জিদনির মা শান্ত গলায় বলল,
-‘জিদনি কে কারা যেন তুলে নিয়ে গেছে।’
বরের বাবা থ গেছে কথাটা শুনে। জিদনির বাবা জিদনির মায়ের দিকে চোখ লাল করে তাকাচ্ছে যায় মানে উনাকে এখন এটা বলছে কেন?
এভাবে উনাদের ওয়েট করানোর মানে খুঁজে পায় না জিদনির মা। আর সত্যি না বলেই বা উপায় কি? বরের বাবা বলল,
-‘কি বলেন এসব? এরকম হলে আমার মান-সম্মান সব যাবে । লোকে আমায় কি বলবে? কত আয়োজন কত টাকা খরচ হয়েছে।’
এক নাগাড়ে কথা গুলো বলে যাচ্ছে বরের বাবা। লোক টা পাগলের মত আচরন করছে।
জিদনির বাবা বলল,
-‘দেখেন আমার একটাই মেয়ে ছেলে টা তো ছোট। আমায় মেয়ে পাচ্ছি না। কত টা কষ্ট,দুঃচিন্তায় আছি আমরা। চারদিকে লোক পাঠিয়েছি। আমরা আপনাদের ব্যাপার টা বুঝতে পারছি কিন্তু আমরা তো নিরুপয়। আমার মেয়েটা কারা তুলে নিয়েছে,কেন নিয়েছে কিছুই জানি না।’
-‘মেয়ে তুলে নিয়ে গেছে নাকি মেয়ে কারো সাথে চলে গেছে?’
-‘মুখ সামলে কথা বলুন। আমাদের মেয়ে নিখোঁজ আগে আমার মেয়ে টা বাঁচুক তারপর বিয়ে। আপনারা ওয়েট করতে না পারলে চলে যান। অযথা চেঁচাবেন না।’
বরপক্ষের সবাই এক জায়গায় জড়ো হয়েছে। এক এক জন এক এক রকম কথা বলছে। সব শুনেও না শোনার ভান করছে জিদনির বাবা।
বরপক্ষের সবাই রীতিমত চিল্লা-পাল্লা শুরু করছে। জিদনির বাবা কে বলছে,
-‘এটা কোন ধরনের ভদ্রতা? এভাবে আমাদের অপমান করলেন কেন?’
জিদনির বাবা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে এঁদের কিছু বলে লাভ নেই।
শেষে অধৈর্য হয়ে বলল,
-‘আপনারা চলে যান।’
-‘আপনাদের পুলিশে দিবো,মানহানি মামলা করবো।’
এবার আর চুপ থাকতে পারলো না জিদনির মা। বলল,
-‘মূর্খ মানুষের মত কথা না বলে এক্ষুনি আমার বাসা থেকে বের হয়ে যান। আমাদের মেয়ে পাচ্ছি না আর উনারা আমাদের পুলিশে দিতে আসছে যা পারেন করেন।’
.
লোক জনের কথায় অতিষ্ট হয়ে যাচ্ছে জিদনির মা-বাবা।
কথা না শুনে উপায় নেই। চুপ-চাপ সবার কথা শুনে যাচ্ছে। বর পক্ষের লোকজন আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে। যাওয়ার আগে বরের বাবা বলল,
-‘কাজটা ভালো করলেন না। আমাদের সব খরচ দিতে হবে। নয়ত থানায় যাবো।’
.
ঘন্টা পেরিয়ে গেলো জিদনি কবুল বলছে না। তূর্য বলল,
-‘বাবা কবুল ছাড়া বিয়ে করা যায় না। সব বিয়েয় যে কবুল বলতে হবে এমন তো কোন কথা নেই।’
কাজী সাহেব হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না।
রাহুল সাহেব ধমক দিয়ে বলল,
-‘তূর্য ইডিয়টের মত কথা বলিস না বাপ।’
কাজী সাহেব অধৈর্য হয়ে বলল,
-‘কি করব বলেন? আর কতক্ষন বসে থাকবো।’
এর ভেতর রাহুল সাহেবের ফোন বেজে উঠে। তূর্যের মা সম্পা বেগমের ফোন। চেয়ার থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে ফোন রিসিভ করলো রাহুল সাহেব । ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলল,
-‘তুমি আর তূর্য কোথায়? তূর্যের তো আরও আগে বাংলাদেশে আসার কথা। ও এখনও বাসায় আসে নি । ফোনও রিসিভ করছে না। আর সত্যি কথা বলো তোমরা কি জিদনির খবর জানো?’
এপাশ থেকে রাহুল সাহেব বলল,
-‘আরে সম্পা এক নিঃশ্বাসে এত কথা বলা ঠিক নয়। এক ধীরে সুস্থে কথা বলো ।এত উদ্বিগ্ন হচ্ছো কেন?’
-‘আমার মনে হচ্ছে তোমরা বাপ-ছেলে মিলে জিদনি কে তুলে নিয়ে গেছো।’
-‘এভাবে বলতে নেই বাজে শুনায় তো। আর আমি জিদনির খবর জানি না। পাগলের মত কথা বলো না।’
-‘ফাজলামি রাখো। জিদনি কোথায় সেটা বলো? অনেক বয়স হয়েছে এবার ভালো হয়ে যাও।’
-‘সম্পা উল্টা-পাল্টা বকো না। আমি কিছু জানি না। আমি অফিসে। ইমপরটেন্ট মিটিং চলছে রাখলাম।’
সম্পা বেগম কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কেটে দিলো।
এসব কাজে ঘোর বিরোধী সম্পা বেগম। তাই উনাকে আপতত এসব জানাতে চাচ্ছে না।
কথা বলা শেষে বারান্দা থেকে এসে রাহুল সাহেব বলল,
-‘তূর্য অনেক হয়েছে এবার তুই গিয়ে ওর মা-বাবার সাথে দেখা করে আয়।’
জিদনি বলল,
-‘আংকেল বাবা-মায়ের কোন ক্ষতি করবেন না পায়ে ধরি।’
-‘পায়ে হাতে ধরতে হবে না কবুল বলো।’
তূর্য উঠে রওয়ানা হলো। জিদনি যেন নিরুপয় হয়ে গেলো। হেচকি দিয়ে কাঁদতে লাগলো ।বুক ফাটা আর্তনাতের মত মুখ থেকে অস্ফূট স্বরে বলল কবুল। তূর্যের চোখ মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল ।
কাজী সাহেব বলল,
-‘আরে মা তিন বার কবুল বলতে হয়।’
তূর্য বলল,
-‘থাক একবার বলাও যা। তিন বার বলাও তা।’
কাজী সাহেব ফিক করে হেসে দিলো । রাহুল সাহেব বলল,
-‘তূর্য এত পাগল হলে চলে?’
জিদনি তিন বার কবুল বলল।
কাজী সাহেব বলল,
-‘তূর্য তুমি কবুল বলবা না?’
তূর্য দাঁত ক্যালিয়ে বলল,
-‘কবুল,কবুল,কবুল।’
রাহুল সাহেব বলল,
-‘আরে বাজান একটু ধীরে সুস্থে বল। একটু ফরমালিটি আছে না।’
চলবে..